পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই নিজ নিজ বাড়িতে অবস্থান করে আসছেন। এতে করে ক্যাম্পাসের কোথাও কেউ নেই। দেখা মেলে না কারো।
নেই কারো আনাগোনাও। সাড়ে সাত একরের এই ছোট ক্যাম্পাসটিতে যেখানে প্রতিদিন প্রায় ষোল হাজার শিক্ষার্থীর আনাগোনায় ভরপুর থাকতো সেখানে কোথাও কারোর দেখা মেলা ভার। যেখানে সকালবেলা সারি সারি বাসে ক্যাম্পাসে আসতো এক ঝাঁক তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী, সেখানে বাসগুলোর যেন নিথর দেহের মতো পড়ে আছে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে।
করোনাভাইরাস যেনো প্রাণচঞ্চল ক্যাম্পাসটিকে একদম স্থবির করে তুলেছে। সকল ব্যস্ততা যেই ক্যাম্পাসকে নিয়ে সেই ক্যাম্পাসই এখন ফাঁকা। করোনাভাইরাস প্রতিটি ক্যাম্পাসের মতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কেও যেনো নিস্তব্ধ করে রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেনো গল্প-আড্ডা থেকে একপ্রকার বঞ্চিত হচ্ছে।
ভুলেই যাচ্ছে চিরচেনা ক্যাম্পাসের প্রকৃতি, বন্ধুদের স্মৃতিকাতরতায় মূখর সবাই। স্মৃতিতে স্মৃতিমন্থন চলে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ভার্সিটি বাসের জন্য অপেক্ষা, কিংবা দৌড়ে বাস ধরা থেকে শুরু করে শেষবেলায় সেই বাসেই নিজ গন্তব্যে পৌঁছানো সবকিছুই যেনো মনে হচ্ছে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের একের পর এক ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন শেষে প্রায়ই একসঙ্গে বসে গল্প, আড্ডা, রসিকতা ও বিনোদনে মেতে উঠা প্রাণচঞ্চল ক্যাম্পাসটাতে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না কাউকে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, ক্যাফেটেরিয়া, শান্ত চত্বর, বিবিএ বিল্ডিং, কাঁঠালতলা সহ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন আড্ডাস্থল একদম ফাঁকা।
ক্যাম্পাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান শান্ত চত্বরটি যেন হাহাকার করছে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ছেলেমেয়েরা পরিবার থেকে দূরে থেকেও যেন আরেক নতুন পরিবার গড়ে তুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ছেড়ে এখন একটা দীর্ঘ সময় ধরে নিজ বাসায় অবস্থান করছে শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেলে ভীষণ তৃপ্তি ও শান্তি। সেই সব কিছু ছেড়ে বাসায় বসে অনলাইন ক্লাসেই মনোযোগী বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা। কাঁঠালতলায় নেই জবিয়ানদের পদচারণা। পাখির কিচিরমিচির, নেই কোনো মিটিং, পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে নেই কোনো মিছিল।
ডিপার্টমেন্ট বন্ধ, ক্লাসরুম ফাঁকা, ফাঁকা লিফটও, নেই কোথাও কোনো কোলাহল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে যেখানে শিক্ষার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা যেত সেখানে এর আশেপাশেও কেউ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত চত্বর, টিএসসি, বিজ্ঞান অনুষদ চত্বর, কলা অনুষদ চত্বর, কাঠালতলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলগেইটের বাহিরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় গেইটের সামনে, বিশ্ববিদ্যালয় বাসের ভেতরে, ক্যান্টিনে, ভাষাশহীদ রফিক ভবণের সামনে, অবকাশ ভবণে, শহীদ মিনারের সামনে, বিভিন্ন একাডেমিক ভবণেও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের আড্ডা এবং খোশগল্পে ভরপুর থাকা ক্যাম্পাসটি শিক্ষার্থী বিহীন নীরব দর্শকের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে।
এখন আর রাতের আড্ডায় মুখরিত হয় না শহীদ মিনার। আইইআর আর পোগোজ স্কুলের সাদা বালুর মাঠ এখন ঘাসের পাহাড়। ক্যাম্পাসের মসজিদটিতেও হয়না তেমন মুসল্লি। কলা ভবন শিক্ষার্থীদের শূন্যতা অনুভব করছে সবচেয়ে বেশি। ফাঁকা বিজ্ঞান ভবনের সামনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসগুলোর অবস্থান। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের সতর্কতা হিসেবে ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখার নোটিশ দেয়া হয় এবং পরবর্তীতে তা সরকারী নির্দেশনায়ই ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
পরবর্তীতে ৯ এপ্রিল করোনা ভাইরাস সঙ্কায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস ও পরীক্ষা পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নোটিশ দেয়া হয়। এছাড়া জবি ক্যাম্পাসে জরুরি বা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া প্রবেশাধিকারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা রয়েছে। দীর্ঘদিন দিন দেখা না হওয়ার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে-অপরের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। করোনা যেনো থমকে দিয়েছে সবই। করোনা ভাইরাস শেষে সবাই মেতে উঠতে চায় বন্ধু-বান্ধুবদের সাথে টিএসসিতে চায়ের আড্ডায়।
এই প্রত্যাশা সকলের। দেশের যেকোনো কঠিন মুহূর্তে যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেকে দেশের কাছে সোপার্ধ করেছে তেমনি দেশের এই মহামারীতেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সোপর্দ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। স্ব স্ব অবস্থান থেকে নিজে সচেতন হয়ে নিজের পরিবার এবং গ্রাম কে করোনা ভাইরাস থেকে সচেতন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। সবার বিশ্বাস একদিন পরিবেশ শান্ত হবে, প্রকৃতি আবার অনুকূলে আসবে। শিক্ষার্থীরা আবারও ফিরে যাবে তাদের প্রাণপ্রিয় জবি ক্যাম্পাসে। তবে সে সময় কবে আসবে, আর কতদিন সেই সময়ের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে হবে সেটা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই বলে দিতে পারেন।