সোমেন সরকার
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের টাকায় দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানী থেকে কেনা ১০ লোকোমোটিভে (ইঞ্জিন) চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ নেই। এই পুকুর চুরি নিয়ে রেলওয়েতে চলছে তুলকালাম কান্ড।
এ ঘটনা ‘ফাঁস’ করায় প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নূর আহাম্মদ হোসেনকে জীবন নাশের হুমকিও দেওয়া হয়। তাতেও ক্ষান্ত না হওয়ায় দায়িত্ব থেকেই সরিয়ে দিয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে জুনিয়র কর্মকর্তার অধীনে বদলির আদেশ জারী করে রেলপথ মন্ত্রণালয়। অথচ উন্নয়ন প্রকল্পে পিডি বদল না করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুশাসন রয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক নূর আহাম্মদ হোসেন বলেন, ঠিকাদার হুন্দাই রোটেমকে ২৫ শতাংশ বিল আগেই দিয়েছে রেলওয়ে। সরবরাহের পর চুক্তিমূল্যের আরও ৬৫ শতাংশ ছাড় করিয়ে নিতে চেষ্টা করছে হুন্দাই রোটেম। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ না দেওয়ায় বিল আটকে দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করতে শুরু থেকেই মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের শীর্ষজনদের চাপ ছিল। ঠিকাদারকে বিল দিতে গত ছয় মাস ধরেই চাপ দেওয়া হচ্ছে। তা না করায় গত কিছুদিন ধরে সরকারি ফোন নম্বরে কল করে জীবননাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইঞ্জিন সরবরাহের স্থানীয় এজেন্টের বাড়ি চট্টগ্রামে। সেখানেই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক পদে বদলি করা হয়েছে আমাকে। অথচ পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) চাকরিতে কনিষ্ঠ। এ আদেশের বিরুদ্ধে তিনি আইনি পদক্ষেপ নেবেন।
এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকেও তেমন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ফোন বন্ধ পাওয়া যায় রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের। রেল সচিব সেলিম রেজাও এ বিষয়ে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন।
রেলওয়ে সূত্রমতে, ৩২৩ কোটি টাকায় কেনা ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেম গত আগষ্টে বাংলাদেশে পাঠায়। করোনার অজুহাত দেখিয়ে সেগুলো প্রাক জাহাজীকরণ পরিদর্শন বা প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন করা হয়নি। দেশে আসার পর পিডির পরীক্ষায় ধরা পড়ে, চুক্তি অনুযায়ী যেসব যন্ত্রাংশ ইঞ্জিনটিতে থাকার কথা, তা নেই।
স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট (মূল যন্ত্রাংশ) যথা ইঞ্জিন, ট্রাকশন মোটর ও অল্টারনেটর না থাকায়, তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান পিডি। পিডি ইঞ্জিন গ্রহণে রাজি না হলেও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের নির্দেশে তা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করে রেলের পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে নেওয়া হয়। বন্দরে জরিমানা এড়াতে মন্ত্রী এ নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে যুক্তি দেখানো হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ইঞ্জিন দেশে আসার পর সেই সময়কার রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঞ্জুর-উল-আলমসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পিডিকে চাপ দেন ইঞ্জিনগুলোর যন্ত্রাংশের বিষয়ে আপত্তি না জানাতে। এ চাপের কথা পিডি রেল সচিবকে চিঠিতে জানিয়েছেন। পিডির আপত্তির পর তদন্ত কমিটি করেছিল রেল। কিন্তু কমিটিতে প্রধান করা হয়েছিল, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তাকেই। পরের পিডির আপত্তিতে কমিটি বদল হয়। তদন্তে আসে চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়নি। হুন্দাই রোটেম তা স্বীকার করেছে। কিন্তু রেল ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
বরং ইঞ্জিনগুলো ব্যবহার করা যাবে কি না- তা জানতে গত ২৩ মার্চ চার সদস্যের কারিগরি কমিটি গঠন করে। হুন্দাই রোটেম দাবি করেছে, তারা যেসব যন্ত্রাংশ দিয়েছে, সেগুলো চুক্তি অনুযায়ী না হলেও নিম্নমানের নয়। কারিগরি কমিটি গঠনই করা হয়েছে ঠিকাদারের এ দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং ইঞ্জিনগুলোকে ব্যবহার উপযোগী সনদ দিয়ে দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিতে। রেলের সর্বোচ্চ পর্যায় এতে জড়িত। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে এসব ইঞ্জিন কেনা হচ্ছে।
অভিযোগ এসেছে, হুন্দাই রোটেম যে চুক্তি অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেয়নি তা রেলওয়েকে জানায়নি সিসিআইসি। প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শনেরও দায়িত্ব ছিল তাদের। মো. শামসুজ্জামান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মঞ্জুর-উল-আলম প্রকল্প কর্মকর্তাদের প্রি-শিপমেন্ট পরিদর্শন করতে দেননি বলে অভিযোগ এসেছে। আর এই পুকুর চুরির মধ্যেও একই প্রকল্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪০টি ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। গত জানুয়ারিতে রেলমন্ত্রী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান ইঞ্জিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে। তখনো প্রকল্প কর্মকর্তাদের নেওয়া হয়নি।
তদন্ত কমিটির সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক ড. মুহ. মাহবুবুর রাজ্জাক বলেছন, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়নি। হুন্দাই রোটেম দাবি করছে, তারা যেসব যন্ত্রাংশ দিয়েছে, সেগুলো দরপত্রের স্পেসিফিকেশনে উল্লিখিত যন্ত্রাংশের চেয়ে ভালো। যন্ত্রাংশগুলো ভালো না খারাপ এ বিষয়টি তদন্ত কমিটি দেখেনি। তদন্তে এসেছে লোকোমোটিভে ইএমডিএস-৮-৭১০জি৩বি-টি১ মডেলের পরিবর্তে কম ক্ষমতার ইএমডিএস ৮-৭১০জি৩বি-ইএস ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে। টিএ১২-সিএ৯ মডেলের বদলে দেওয়া হয়েছ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী স্পেসিফিকেশন মতো যন্ত্রাংশ না থাকলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিন রিপ্লেসমেন্ট বা বদল করে দিতে বাধ্য। তা না করলে রেল মন্ত্রণালয় ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত (ডিবার) করে মামলা করতে পারবে। তবে রেল মন্ত্রণালয় এ পথে না গিয়ে ইঞ্জিনগুলোকে ভালো হিসেবে দেখাতে ‘কারিগরি কমিটি’ করে। চুক্তি অনযায়ী যন্ত্রাংশ দেওয়া হয়নি জেনেও রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের নির্দেশে এসব ইঞ্জিন খালাস করা হয়েছিল।
Like this:
Like Loading...
Related
এ জাতীয় আরো খবর..