কে এই হেলেনা জাহাঙ্গীর, যে সব কারণে এসেছেন আলোচনা-সমালোচনায়
তৌহিদ আহমেদ রেজা,
কে এই হেলেনা জাহাঙ্গীর, যে সব কারণে এসেছেন আলোচনা-সমালোচনায়
গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সরগরম হেলেনা জাহাঙ্গীর ইস্যু। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচিত এই ব্যবসায়ীর আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে। এবার তার গুলশানের বাসায় অভিযান চালাচ্ছে র্যাবের একাধিক টিম।
ফেসবুকে বেশ সক্রিয় হেলেনা জাহাঙ্গীর মূলত একজন নারী উদ্যোক্তা হলেও কিছুদিন ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মনোনয়ন পাননি। সম্প্রতি কুমিল্লা-৫ আসনের উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু মনোনয়ন পাননি।
কুমিল্লার মেয়ে হেলেনা জাহাঙ্গীরে ব্যবসায়ী হিসেবে উত্থান খুব বেশিদিন আগের নয়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যায় তার। হেলেনার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় জাহাঙ্গীর। বিয়ের পর শেষ করেন স্নাতকোত্তর। এরপর উদ্যোক্তা হিসেবে পথ চলা শুরু।
ব্যবসায়ীর বাইরে তিনি একাধিক সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন বলে জানা গেছে। হেলেনা জাহাঙ্গীর গুলশান ক্লাব, গুলশান নর্থ ক্লাব, বারিধারা ক্লাব, কুমিল্লা ক্লাব, গলফ ক্লাব, গুলশান অল কমিউনিটি ক্লাব, বিজিএমইএ অ্যাপারেল ক্লাব, বোট ক্লাব, গুলশান লেডিস ক্লাব, উত্তরা লেডিস ক্লাব, গুলশান ক্যাপিটাল ক্লাব, গুলশান সোসাইটি, বনানী সোসাইটি, গুলশান জগার্স সোসাইটি ও গুলশান হেলথ ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
জানা গেছে, হেলেনা জাহঙ্গীর প্রিন্টিং, অ্যামব্রয়ডারি, প্যাকেজিং, স্টিকার এবং ওভেন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। জয়যাত্রা গ্রুপের আওতায় এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। সব মিলিয়ে ১০ হাজারেও বেশি কর্মী আছে তার এসব প্রতিষ্ঠানে।
হেলেনা জাহাঙ্গীর ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সদস্য ও নির্বাচিত পরিচালক। এ ছাড়া তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএরও সক্রিয় সদস্য তিনি। ‘জয়যাত্রা’ নামে একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশনেরও মালিক তিনি।
যেভাবে হেলেনার উত্থান
হেলেনা জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৭৪ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার তেজগাঁওয়ে। উইকি ফ্যাক্টসাইডার নামের একটি ওয়েবসাইটে তার পেশা হিসেবে অ্যাংকর বা উপস্থাপক উল্লেখ করা হয়েছে। হেলেনার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম একজন ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সালে তারা বিয়ে করেন। তিনি তিন সন্তানের জননী।
হেলেনা জাহাঙ্গীরের বাবা মরহুম আবদুল হক শরীফ ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। সেই সূত্রে জন্ম কুমিল্লায় হলেও হেলেনা জাহাঙ্গীরের বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের হালিশহরের মাদারবাড়ী, সদরঘাট এলাকায়। পড়াশোনা স্থানীয় কৃষ্ণচূড়া স্কুলে।
এফবিসিসিআই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একাধিক গণমাধ্যমকে হেলেনা জাহাঙ্গীরের দেয়া সাক্ষাৎকার সূত্রে জানা যায়, বিয়ের সময় স্বামী জাহাঙ্গীর আলম নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠিত পোশাক কারখানার জিএম পদে চাকরি করতেন। পাশাপাশি সিএন্ডএফ এজেন্ট ব্যবসার সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল।
তবে গৃহিণী হিসেবে বসে না থেকে পড়াশোনা শেষ করে হেলেনা জাহাঙ্গীর শুরুতে চাকরির চেষ্টা করেন। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য ইন্টারভিউও দিয়েছেন তিনি। একদিন চাকরি খোঁজার সূত্র ধরে চলে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলমের অফিসে। সেখানে স্বামীর অফিস কক্ষ দেখে তিনি ঠিক করেন নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার। স্ত্রীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান স্বামী জাহাঙ্গীর আলম।
বিয়ের ছয় বছর পর ১৯৯৬ সালে রাজধানীর মিরপুর ১১ তে একটি ভবনের দুটি ফ্লোর নিয়ে তিনি শুরু করেন প্রিন্টিং ও অ্যামব্রয়ডারি ব্যবসা।
সম্প্রতি চাকরিজীবী লীগ নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নেতা বানানোর আহ্বান জানানোর একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে বিতর্ক জন্ম দেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। কথিত এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবে হেলেনা জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাহবুব মনিরের নাম উল্লেখ করা হয়।পরে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটি থেকে তার সদস্য পদ বাতিল করা হয়।
গত রবিবার হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উপকমিটির সদস্যসচিব ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ সই করেন। এতে বলা হয়, হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সংগঠনের নীতিবহির্ভূত হওয়ায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ হতে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য হয়েই দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া। নিজের প্রচার-প্রকাশনায় বিভোর থাকা এক সমালোচিত ব্যক্তিত্ব হেলেনা জাহাঙ্গীর। ব্যবসায়ীক সংগঠনের সাবেক এই সভাপতি ভাইরাল ব্যক্তি ও বিষয়ের উপর ভর করে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করেছেন। নিজেকে আলোচনায় নিয়ে আসতে নানা সমালোচনার জন্মও দিয়েছেন তিনি। আওয়ামী লীগ থেকে বারবার বিভিন্ন জায়গায় মনোনয়ন চেয়েও বঞ্চিত হয়েছেন তিনি।
বিভিন্ন সময়ে তার নানান কর্মকাণ্ড ও বক্তব্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ক্ষমতারও লালসা। তিনি একাধিক বার তার প্রমাণও দিয়েছেন। এর মধ্যে ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে যতেষ্ট চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। নিজের ঢাক-ঢোল পেটাতে উত্তর সিটির সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও গণপরিবহনে দেখা গিয়েছিল তার পোষ্টার। বড় বড় করে সাটিয়েছিলেন ফেস্টুন। কিন্তু পদ বঞ্চিত হন তিনি। মনোনয়ন পান করপোরেশনের বর্তমান মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম।
সম্প্রতি কুমিল্লা-৫ (ব্রাক্ষণপাড়া-বুড়িচং) আসনের উপ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। সংগত কারনে মনোনয়নপত্রও কিনেছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। নিজেকে সমাজসেবী, নারীবাদীসহ নানান তকমা দিয়ে মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন এফবিসিসিআই এর সাবেক এই সভাপতি। কিন্তু তাকে সে পদের যোগ্য বলে মনে করেনি আওয়ামী লীগ। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত হন হেলেনা।
হেলেনা জাহাঙ্গীর লায়ন্স, নোটারিসহ বেশ কিছু ক্লাবের সদস্য। নিজেকে আলোচনায় রাখতে সামাজিক কর্মকাণ্ডের মত বিষয়কে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আর নিজের কাজের চাইতে কয়েকশো গুণ বেশি প্রচারণা করতেন তিনি- এমন ভাষ্য তারই নিকটজনদের। ব্যক্তিগত ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ও নানান মাধ্যমে নিজের প্রচারণায় বেশি মনোযোগি ছিলেন তিনি।
নিজেকে আরও কিছুটা মেলে ধরতে একটি আইপি টেলিভিশন চালু করেছেন হেলেনা। জয়যাত্রা নামের অবৈধ এই নামমাত্র টেলিভিশনটির মাধ্যমে তিনি হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় প্রতিনিধি নিয়োগের জন্য টাকা নিয়েছেন তিনি। যা গণমাধ্যমে নিয়মের সম্পূর্ণ বিপরীত। অবৈধ চ্যানেল পরিচালনা, সেখান থেকে অর্থ আত্মসাৎ এমন চ্যানেলের নাম ভাঙিয়ে নানান চাঁদাবাজিও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে নানান সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তার বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্য অনেক গণমাধ্যম অঘোষিতভাবে তাকে বয়কটও করেছে।
রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম প্রতারকদের একজন। বেশ কিছু দিন আগে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র্যা ব অভিযান করে তাকে গ্রেপ্তার করে। সেই সাহেদের সঙ্গেও হেলেনা জাহাঙ্গীরের সখ্যতা ছিল এমন প্রমাণ মিলেছে।
দলের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে কখনই ছিলেন না হেলেনা। তারপরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী বিএনপি নেতা মালেকের সঙ্গে এক টকশোতে অংশ নেন তিনি। সেই টকশোতে তিনি বেশ অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন। তার অশালীন বক্তব্য নানান প্রশ্নের জন্ম দেয়। যা নিয়ে বাংলা ভাষাভাষী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে নানান সমালোচনা শুরু হয়।
এরপর ভার্চুয়ালি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব সেফু দা’র সঙ্গেও এক টকশোতে দেখা গেছে তাকে। মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কোনো ব্যক্তি এ ধরণের টকশোতে অংশ নিতে পারেন, এমন ধারণা ছিল না কারোই। সে টকশোতে বিরাট সমালোচনার জন্ম দেন হেলেনা।
কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেনের সঙ্গে এক টকশোতে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে হেলেনা জাহাঙ্গীরকে। দলের সিনিয়র নেতার সঙ্গে হেলেনা ব্যবহার রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা বোট ক্লাবে অভিনেত্রী পরিমনির ঘটনায় নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টাও হাত ছাড়া করেননি বিতর্কিত এই নেত্রী। ঘটনার পর বোট ক্লাবে গিয়ে লাইভ করেন তিনি। সেখানে নানান বিতর্কিত কথাও বলেছেন হেলেনা। পাশাপাশি ভাইরাল ঘটনায় উপর ভর করে নিজেকে ভর করার সমস্ত চেষ্টাই চালিয়েছেন তিনি।
সর্বশেষ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ নামে এক ভুঁইফোড় সংগঠনের নামে অনলাইনে প্রচারণা চালাতে দেখা যায় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে। নিজের ছবি সম্বলিত পোষ্টার দিয়ে ভুঁইফোড় সংগঠনটির প্রচারণা ও কর্মী জোগাড়ের চেষ্টা করেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে নানান ভাবে নিজের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন সরকার দলীয় সদ্য সাবেক এই নেত্রী।
আজ রাত সাড়ে আটটার দিকে তার বাসায় তল্লাশি চালায় পুলিশের এলিট ফোর্স-র্যাব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বিতর্কিত এই নারী। তল্লাশিকালে হেলেনার বাসা থেকে উদ্ধার হয় বিপুল পরিমাণ মাদক।
র্যাব সূত্র জানা গেছে, মাদক উদ্ধারের ঘটনায় তাকে আটক করা হয়েছে। মাদক রাখার কারণ ও এ বিষয়ে আরও তদন্তের স্বার্থে তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। গত রবিবার হেলেনা জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি দিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে উপকমিটির সদস্যসচিব ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মেহের আফরোজ সই করেন। এতে বলা হয়, হেলেনা জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত তাঁর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড সংগঠনের নীতিবহির্ভূত হওয়ায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক উপকমিটির সদস্যপদ হতে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।