অন্ধকার জগতে আতঙ্ক তোলপাড়
তৌহিদ আহমেদ রেজা,
অন্ধকার জগতে আতঙ্ক তোলপাড়
সেই পাপিয়া থেকে পিয়াসা পরীমনি মৌ গ্রেপ্তারের পর এখন অন্ধকার জগতজুড়ে আতঙ্ক তোলপাড় চলছে। অভিযান কতদূর যাবে, কাদের আটক করা হবে এ নিয়ে চলছে আলোচনা। যারা নানা অপকর্ম করে আসছিলেন, অপরাধের সাথে জড়িয়ে ভোগ বিলাস, অর্থবিত্তের নেশায় বেহুশ ছিলেন তাদের হুশ ফিরেছে। ভয় তাড়া করে ফিরছে তাদের।
গত ১ আগস্ট গুলশানের বারিধারায় মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার বাসায় অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাত ১২টার পরপর তাকে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাসার ভেতর তল্লাশি চালিয়ে মাদকদ্রব্য জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একই রাতে মডেল মরিয়ম আক্তার মৌয়ের রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। তার বাসা থেকেও বিপুল পরিমাণ মদ উদ্ধার করা হয়। পরে রাত ১টার দিকে মৌকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
২ আগস্ট শুনানি শেষে ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌয়ের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। তাদের চলমান রিমান্ড থেকে বেরিয়ে আসছে নানা কেলেঙ্কারির তথ্য। সেই সূত্র ধরেই পুলিশ এই চক্রের জিসান ও মিশুকে গ্রেপ্তার করে। জানা গেছে, এই চক্রটি রাজধানীতে অভিজাত এলাকায় ডিজে পার্টির আসর বসায়। আসরে যোগ দেওয়া ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সুযোগ বুঝে ব্ল্যাকমেইল করে। এই প্রতারক ও মাদক চক্রের সন্ধানে উঠে আসে চিত্রনায়িকা পরীমনির নামও।
তারপরই ৪ আগস্ট বিকালে রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত পরীমনির বাসায় টানা ৩ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার কর র্যাব। এ সময় র্যাব জানায়, সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই পরীমনির বাসায় অভিযান চালানো হয়। তার বাসায় অবৈধ মদ এবং বিপুল পরিমাণ মাদক পাওয়া যায়। মিনি বারের সন্ধানও মিলেছে তার বাসায়। এসব অবৈধ মাদক রাখার দায়ে পরীমনিকে প্রথমে আটক, পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পরীমনিকে গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা পরেই রাজ মাল্টিমিডিয়ার স্বত্বাধিকারী ও চলচ্চিত্রাঙ্গনের পরিচিত মুখ নজরুল ইসলাম রাজকে মাদকসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। রাত ১০টার পর গুলশানের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাসা থেকে উদ্ধার হয় বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ, সিসা ও সিসা খাওয়ার সরঞ্জামাদি। এ সময় রাজ তার এক সহযোগীকে নিয়ে বাসায় অবস্থান করছিলেন। নজরুল ইসলামও পরীমনির সঙ্গে ব্ল্যাকমেইলসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন বলে র্যাবের কাছে প্রাথমিক তথ্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ, পরীমনির পর নজরুল ইসলাম রাজ। ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌয়ের যোগসূত্র রয়েছে। আবার পরীমনি-নজরুল রাজের যোগসূত্র রয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেছে। পিয়াসা-মৌ গ্রেপ্তারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ন কমিশনার হারুণ অর রশিদ বলেছেন, ‘এরা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তাদের টার্গেট হলো কোটিপতি ব্যবসায়ী বা ব্যবসায়ীদের সন্তানেরা। বিভিন্ন ক্লাব বা বারে গিয়ে তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে ব্ল্যাকমেইল করতো তারা। একই সঙ্গে তারা বাসায় নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্যের আসর বসাতো। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে সহযোগীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।’
স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হচ্ছে, এই চক্রের এখানেই শেষ নয়। গভীরে রয়েছে আরো অনেকেই। ফলে আরো অভিযান পরিচালিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে—পিয়াসা, মৌ, পরীমনি, রাজের পর কে?
ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ, পরীমনির মতো আরো এক ডজনের বেশি মডেল ও অভিনেত্রীর তালিকা প্রস্তুত করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এদের বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইলিং ও মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তালিকায় থাকা এসব মডেল-অভিনেত্রীদের নজরদারিতে রেখেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদেরকেও গ্রেপ্তার করা হবে।
ডিবি বলছে, কীভাবে এই কথিত মডেলরা ধনাঢ্যদের টার্গেট করতেন এবং পরে তাদের নিজেদের বাসায় বা অন্য জায়গায় পার্টির নামে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের উদ্দেশ্যে ভিডিও ও ছবি ধারণ করতেন, এসব বিষয় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছেন পিয়াসা ও মৌ।
সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ব্ল্যাকমেইল করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন ওই কথিত মডেলরা। লাখ টাকা ভাড়ার ফ্ল্যাট, কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি, বিলাসি জীবন সবই ব্ল্যাকমেইলিং এবং অবৈধ উপায়ে উপার্জিত টাকায়। বড় ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের টার্গেট করে ব্ল্যাকমেইল করত ওই কথিত মডেলরা।
ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পিয়াসা ও মৌয়ের মোবাইলে বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া গেছে। এগুলো তারা গোপনে ধারণ করেছিলেন। তাদের মোবাইল থেকে এবং জিজ্ঞাসাবাদে এ ধরনের কাজে জড়িত আরও কিছু মডেলের নাম পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই বাছাই চলছে।
এদিকে র্যাব বলছে, রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বিভিন্ন পার্টির আয়োজন করতেন মিশু। পরীমনিসহ বিভিন্ন মডেলদের এসব পার্টিতে হাজির করতেন তিনি।
র্যাব জানায়, তারা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। এই চক্রের সদস্য প্রায় ১০ থেকে ১২ জন। তারা রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকা বিশেষ করে গুলশান, বারিধারা, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পার্টি বা ডিজে পার্টির নামে মাদক সেবনসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করে থাকে। এসব পার্টিতে তারা অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে। অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্য।
সংস্থাটি বলছে, প্রতি পার্টিতে ১৫-২০ জন অংশগ্রহণ করত। এছাড়া বিদেশেও প্লেজার ট্রিপের আয়োজন করা হত। একইভাবে উচ্চবিত্ত প্রবাসীদের জন্যেও দুবাই, ইউরোপ ও আমেরিকায় এ ধরনের পার্টি আয়োজন করতেন অভিযুক্তরা। ক্লায়েন্টদের একান্ত মুহূর্তের ছবি ধারণ করে অপব্যবহার করা হত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন তারা।
র্যাব বলছে, পার্টি আয়োজনের ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টের চাহিদা ও পছন্দের গুরুত্ব দিয়ে পার্টি আয়োজন করা হত। গ্রেপ্তাররা তাদের এই অবৈধ অর্থ নামেবেনামে বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে।