মিহিরুজ্জামান জেলা প্রতিনিধি সাতক্ষীরাঃ
সাতক্ষীরায় অবশেষে শিক্ষার্থীদের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটল।দেড় বছর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাণের স্পন্দন। (১২ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকেই সারা দেশের ন্যায় সাতক্ষীরা জেলার ৩০৭টি স্কুলের বিপরীতে ৩০৬টি স্কুল, ২১৪টি মাদ্রাসার বিপরীতে ২১৩টি মাদ্রাসা, ৫৮টি কলেজ, ১১টি স্কুল এন্ড কলেজ, ১হাজার ৯৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১১০টি কিন্ডারগার্টেনসহ মোট ১ হাজার ৭৯৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছুটে যায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।বিদ্যালয়ের সেই চিরচেনা ঘণ্টার শব্দের আওয়াজে শিক্ষার্থীরা মেতে ওঠেন আনন্দ-উল্লাসে, মুক্তির নি:শ্বাসে।
তবে শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে উৎসবের আমেজ আনন্দ বিরাজ করলেও করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের অনেকে ছিলেন উৎকন্ঠায়।গতবছর করোনা ভাইরাসের সংক্রামণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনায় এনে দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে প্রায় আঠারো মাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছিলো। এতে করে দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় সাতক্ষীরায়ও লক্ষাধিক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছিলো। শুধু প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬২ হাজার, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের প্রায় ৫০হাজার শিক্ষার্থী এই ঝরে পড়ার তালিকায় ছিলো। এছাড়াও করোনাকালীন এই সময়ের ভিতরে বাল্যবিবাহের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। জেলার এক বিদ্যালয় থেকে ৫০জন ছাত্রীর বাল্যবিবাহের ঘটনাও ঘটে।
তবে করোনাকালীন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিতরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানগুলো। জেলার ১১০টি কিন্ডারগার্ডেনের মধ্যে করোনাকালীন সময়ে বন্ধ হয়ে যায় ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও ১৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। এতে করে চাকরি হারিয়ে বিপাকে পড়ে ওই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। তবে দেশে করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ থাকার পর (১২ সেপ্টেম্বর) থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তারা।এদিকে জেলা শহরের খানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
দক্ষিণ সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আলিপুর ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহ একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করছে। তাদের পরণে সেই চিরচেনা স্কুল ড্রেস, কাঁধে বইয়ের ব্যাগ। তবে করোনার স্বাস্থ্যবিধি মেনে মুখে মাস্ক পরিধান করে স্কুলে এসেছে তারা। স্কুলগুলোর প্রধান ফটকে শিক্ষার্থীদের তাপমাত্রা মেপে প্রবেশ করানো হচ্ছে। তাদেরকে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ফটকে স্কুলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে শিক্ষকদেরও অবস্থান করতে দেখা গেছে।
বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়ার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতার দিকে সর্বোচ্চ নজর দিয়েছে। জেলার অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বার রঙিন বেলুন দিয়ে সজ্জিত করার পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীদের বরণ করতে শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রস্তুতিও ছিল ব্যাপক। শিক্ষার্থীদের ভয়-ভীতি দূর করতে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে দেখা যায় উৎসাহ। শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানাতে তারা নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান নিয়েছেন।
সারিবদ্ধভাবে শ্রেণিকক্ষে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অভিভাবক সকলের মুখেই ছিল মাস্ক। শিক্ষার্থীরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে। শ্রেণিকক্ষেও ছিল পারস্পরিক নিরাপদ দূরত্ব। প্রতি বেঞ্চে জেড পদ্ধতিতে একজন করে শিক্ষার্থীরা আসন গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের বেঞ্চ থেকে শিক্ষকের পাঠদানের স্থানও ছিল নিরাপদ দূরত্বে।
প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা সশরীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ঘোষণা এখনো না আসলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা আসতেই শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। এদিকে শিক্ষার্থীরাও বিশেষ করে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের শিক্ষার্থীদের মাঝেও এসেছে স্বস্তির নি:শ্বাস।এবিষয়ে সাতক্ষীরা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিইও) মো: রহুল আমীন বলেন, জেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীদের বরণ করে নেওয়া হয়েছে।
আজকে ৫ম শ্রেণি ও ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে রুটিন অনুযায়ী অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হবে বলে জানান তিনি। এসময় তিনি বলেন, বিদ্যালয় খোলার প্রথমদিন প্রাথমিকে অধ্যায়ণরত শিক্ষার্থীদের ভিতরে গড় ৮৭ ভাগ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলো।
তবে, স্কুল খুললেও কোনো অ্যাসেম্বলি হবে না। পড়াশোনায় কোনো চাপও থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দুই মাসের মধ্যে কোনো ধরনের মূল্যায়ন ও আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা না নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বা দেহে কোনো ধরনের উপসর্গের কারণে যদি শিক্ষার্থীরা সশরীরে উপস্থিত হয়ে ক্লাসে যোগদান করতে না পারে, তাহলে তাদের অনুপস্থিত হিসেবে গণ্য করা হবে না। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকালে শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) থেকে আলাদাভাবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনাসহ বেশকিছু সতর্কতা ও সচেতনতামূলক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আর সেই নির্দেশনা মেনে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরকে পাঠদান করানোর জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।এবিষয়ে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এসএম আব্দুল্লাহ্ আল মামুন বলেন, জেলার সকল স্থানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতের হার সন্তোষজনক। তবে জলাবদ্ধতার কারণে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের একটি মাদ্রাসায় পাঠদান করানো সম্ভব হয়নি। তাদেরকে পার্শ্ববর্তী একটি বিদ্যালয়ের রুম ব্যবহার করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার জন্য বলা হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষকদের ভিতরে বিরোধকে কেন্দ্র করে চম্পাফুলের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান হয়নি। তবে এবিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
Like this:
Like Loading...
Related
এ জাতীয় আরো খবর..