ধলেশ্বরী নদী থেকেই বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। এখনকার বুড়িগঙ্গার সঙ্গে আগের তফাৎ আকাশ-পাতাল। বর্ষাকালে এ নদী তীরের জনপদকে জলমগ্ন ভেনিস নগরীর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতেন ইউরোপের বণিকরা। ১৮০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক আবাসিক প্রতিনিধি জন টেইলর বুড়িগঙ্গা নদীর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে, তখন দূর থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো।
মূলত বুড়িঙ্গার উন্নয়ণ ঘটে মোগল সুবেদারদের হাত ধরেই। এই জনপদকে আরেকটু রাঙিয়ে দিতে নদীর সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করেছিলেন বাংলার সুবেদার মুকাররাম খাঁ। তার শাসনামলে শহরের যে সকল অতুশ নদীর তীরে অবস্থিত ছিল সেখানে প্রতিরাতে আলোকসজ্জা করা হতো। এছাড়া নদী বুকে অসংখ্য জ্বলতো ফানুস বাতি। বুড়িগঙ্গা তীরে তৈরি হতো এক অপরূপ সৌন্দর্য। আর নৌকা ছাড়া কি নদীর সৌন্দর্য ঠিক-ঠাক প্রকাশ পায়? সেই আঠারো শতকের আগে থেকেই ঢাকার বুকে নেমেছিল বাণিজ্যিক নৌকা।
রাজ-রাজাদের কাহিনি, বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা পর্যটক ও বণিকদের বিচরণের গল্পও আছে বুড়িগঙ্গা অধ্যায়ে। অদেখা মোগল বা ব্রিটিশ শাসকদের আনাগোনা, নবাবদের রাজকীয় দরবার, সৈন্যদের কুচকাওয়াজ এসব আজও যেন ইতিহাসের চোখে ভাসে। এসব তো তখন জলযান কেন্দ্রিকই ছিল। ১৯২৬ সালে ঢাকায় এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন বুড়িগঙ্গার বুকেই ‘তুরাগ’ নামক হাউজ বোটে রাতযাপন করেন তিনি। তিনি চড়েছেন পালতোলা বাহারি নৌকায়। এমনকি আহারও গ্রহণ করেছেন বুড়িগঙ্গায় বুকে চলতে থাকা নৌকায় বসে।
বুড়িগঙ্গা একসময় ছিল কখনও ভারী বর্ষণ শেষে প্রমত্তা নদী, আবার কখনও ছিল নিঃশব্দে বয়ে চলা শান্ত নদী। রাতের আঁধারে নিঃসঙ্গ নৌকার বুকে টিমিটিম করে জ্বলতো বাতি। নৌকায় আহার করতেন দূর থেকে আসা মাঝি-মাল্লারা।
‘ঢাকা পুরাণ’ গ্রন্থে মীজানুর রহমান ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, দূর-দুরান্ত থেকে মাল্লাই দোমাল্লাই নৌকা এসে ভিড়তো নারিন্দার পুলের আশেপাশে। এসব নৌকায় বেদেরা নিয়ে আসতো মাটির হাঁড়ি, কলসি ও অন্যান্য তৈজসপত্র থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু। তখন ঘাটজুড়ে চোখে পড়তো বেদেদের নৌকার বহর।
নদীর স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সময়ও ধেয়ে চলছে আপন বেগে। সেই সময়ের ক্ষুধার্ত গর্ভে নদী তীরে গড়ে ওঠা বহু অট্টালিকা হারিয়ে গেছে। ইতিহাসে এমনও আছে, প্রবল স্রোতে নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে সুবেদারের নৌ-বহর, রচিত হয়েছে তাদের সমাধি। বিভিন্ন লেখায় পাওয়া যায়, ৫০ বছর আগেও নদীর আক্রোশ মেটানোর জন্য লোকে লবণ, চিনি দান করেছে পানিতে। খোয়াজ-খিজিরের দোহাই দিয়ে মানত করে ভেলা ভাসিয়েছে।
বুড়িগঙ্গার উপর সেতু নির্মাণ শুরু হয় আশির দশকে। ১৯৮৯ সালে এই সেতু ঢাকার মানুষদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে নদী পার হতে এখনো মানুষ ভরসা রাখে নৌকায়। কারণ নৌকায় সময় লাগে অনেক কম।
ঢাকা থেকে নদীর ওপার যেতে বাবুবাজার মোড় থেকে ছাড়ে বাস, অটো রিকশা কিংবা অন্যান্য যানবাহন। একইভাবে ঢাকা আসতে দক্ষিণকেরানিগঞ্জবাসীকে যেতে হয় কদমতলী। বাবুবাজার মোড় কিংবা কদমতলী যেতে যতসময় লাগে, ততক্ষণে নৌকায় পার হয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যান স্থানীয়রা। তাই নৌকার আবেদন আছে এখনো!
আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, বর্ষায় বুড়িঙ্গার বুকে এখনো চিরাচরিত বাংলার হারানো ঐতিহ্য পালতোলা নৌকা দেখা যায়। ইঞ্জিনচালিত নৌকার দৌরাত্ম্যে হারিয়ে যেতে বসলেও প্রতিবছর বর্ষায় চলাচল করতে দেখা যায় বেশ কিছু পালতোলা নৌকা। বাতাস থাকায় খেয়া পারাপারের নৌকার মাঝিরা পাল তোলেন।
বুড়িগঙ্গাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল ঢাকা। বুড়িগঙ্গা ঢাকার জন্মদাত্রী মা। এখন অবয়বের বদল হয়ে বুড়িগঙ্গা যেন সিংহাসন হারানো কোনো নারী। এতে আগের মতো খেলা করে না রূপালি ঢেউ। তারপরও কিছু বিষয় এখনো বুড়িগঙ্গার বুকে বুক চিতিয়ে লড়ছে। তার মধ্যে অন্যতম নৌকা।