আনোয়ার হোসেন আন্নু বিশেষ প্রতিনিধিঃ
ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি, নকশার কাজ শেষ। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর নির্মাণকাজ। এখন চলছে সেতুর মূল অংশের কাজ। স্টিল অবকাঠামোর এ সেতুতে লাইন থাকবে দুটি। পারাপারের জন্য কোনো ট্রেনকে তাই অপেক্ষা করতে হবে না। ট্রেনও চলতে পারবে সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে। ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সংযোগ তৈরি করতেও সহায়তা করবে এই সেতু। নির্মাণ শেষ হলে এটিই পাবে দেশের দীর্ঘতম রেলসেতুর তকমা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, যমুনা নদীর ওপর যে বঙ্গবন্ধু সেতু রয়েছে, সেই সড়ক সেতুর ৩০০ মিটার উজানে এটি নির্মিত হচ্ছে, যার দৈর্ঘ্য ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। দেশের সবচেয়ে বড় এ রেলসেতুতে মোট পিয়ার (খুঁটি বা পিলার) থাকবে ৫০টি। ১০টি পিয়ারের কাজ এরই মধ্যে শেষ। আরও ছয়টি পিয়ারের স্টিল পাইপ শিল পাইপ (এসপিএসপি) ড্রাইভিংয়ের কাজ চলমান। ক্রেনের সাহায্যে হ্যামার দিয়ে বসানো হচ্ছে পাইলিং পাইপ। রেলসেতুর পিয়ার হবে কংক্রিটের। ওপরের সুপার স্ট্রাকচার হবে স্টিলের। দেশে যেমন সেতুর পাইলিং কাজ চলমান, অন্যদিকে সুপার স্ট্রাক্চারের কাজ চলমান ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে।
পিলারের কাজ শেষ হলেই বিদেশ থেকে সুপার স্ট্রাক্চার এনে বসিয়ে দেওয়া হবে। প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজের অগ্রগতি ৩৪ শতাংশ ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ২৩ শতাংশ।
বঙ্গবন্ধু রেলসেতুটির কাজ শেষ করার সময়সীমা ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬ হাজার ৭শ কোটি টাকা। ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন বা জাইকার কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পাবে বাংলাদেশ। বাকি অর্থ দেবে বাংলাদেশ সরকার। দ্রুত চলমান প্রকল্পের ব্যয় ও সময়সীমা বাড়ানো লাগবে না। অনুমোদিত ব্যয় ও সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, দ্রুতগতিতে প্রকল্পের কাজ চলমান। তবে কোভিডে কিছুটা কাজে ভাটা পড়েছিল। এখন পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের কাজ শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দেশে যেমন পিয়ারের পাইলিং চলমান, তেমনি ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে সুপার স্ট্রাক্চারের কাজ চলছে। পিয়ারের কাজ সম্পন্ন হলে সুপার স্ট্রাকচার পার্ট পার্ট করে সেটিং করা হবে।
জানা যায়, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সংযোগ তৈরি করতে সহায়তা করবে এই সেতু। বর্তমানে বাংলাদেশের যে রেলসেতুগুলো রয়েছে তাতে আছে একটি করে লাইন। এই সেতুতে দুটি লাইন থাকবে। কোনো ট্রেনকে সেতু পার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। সেতুতে একসঙ্গে দুটো ট্রেন দুদিকে চলে যেতে পারবে।
যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সড়কসেতুতে যে রেললাইন রয়েছে তা পার হতে দুই পাশে ট্রেনকে অপেক্ষা করতে হয়। এছাড়াও সড়কসেতু হওয়ায় ওজন ও গতির বিষয়েও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। বঙ্গবন্ধু সড়কসেতুতে একটি ট্রেন ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার বেগে চলাচল করতে পারে। নতুন সেতুটিতে ঘণ্টায় চলতে পারবে সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার বেগে। এর ওপর দিয়ে যে কোনো ওজনের মালবাহী ও যাত্রীবাহী ট্রেনও চলতে পারবে। এছাড়া একাধিক লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানো যাবে।
সাধারণত মালবাহী ট্রেনগুলোকে প্রায়ই দুটি ইঞ্জিন দিয়ে টানতে হয়। বঙ্গবন্ধু সড়কসেতুতে যা সম্ভব হয় না। এ কারণেই যমুনা নদীর ওপারে পার্বতীপুরের কারখানায় মেরামতের জন্য ইঞ্জিন নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। রেলসেতুটি নির্মাণ করা হলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
৯ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে রেলসেতুটি নির্মাণ করার কথা থাকলেও প্রথম সংশোধনীর পর সেতুর প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৭শ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন থাকবে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ বা চার হাজার ৬৩১ কোটি টাকা এবং জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দেবে ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা, যা পুরো প্রকল্পের ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ।
সেতুর দুই পাশে দশমিক ০৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট, ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ ও সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব ও বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম স্টেশন ভবন আধুনিকের পাশাপাশি ইয়ার্ড রিমডেলিং করা হবে। সেতুর এই দুই পাশের স্টেশনের সিগন্যাল ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা করা হবে উন্নত। এছাড়া ওই সেতু এলাকায় নির্মিত হবে রেলওয়ে সেতু জাদুঘর।