কংকন দাশ, চট্টগ্রাম :
সারাজীবনের সঞ্চয় দিয়ে নগরীর ২৫ নম্বর রামপুরা ওয়ার্ডে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন প্রবাসী সিরাজুল ইসলাম। তামান্না বিল্ডার্স নামে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান থেকে ফ্ল্যাটটি কিনেছেন তিনি কিস্তিতে। আরও সাত বছর আগে পরিশোধ করেছেন তিনি কিস্তির সব টাকা। কিন্তু তামান্না বিল্ডার্স চুক্তি অনুযায়ী ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে পারেনি ক্রেতাকে। শুধু তামান্না বিল্ডার্স নয়; নগরীতে এমন চুক্তি ভঙ্গকারী ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান আছে অনেক। এ জন্য রিহ্যাব চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় বিভিন্ন অভিযোগ গ্রহণ করতে গঠন করেছে স্বতন্ত্র একটি সেল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রামের এই সেলে ৮২টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৬১টি অভিযোগের সমাধান করা হয়েছে। বাকি ২১টি প্রক্রিয়াধীন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রিহ্যাব একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদ বাতিল করেছে।
দুইভাবে এমন প্রতারণা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন রিহ্যাব চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সিডিএ ও সিটি করপোরেশন আন্তরিক হলে এসব প্রতারক প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে গ্রাহকদের রক্ষা করা সম্ভব। সরকারি সার্কুলার বলছে, রিহ্যাবের সদস্য হওয়া ছাড়া কেউ আবাসন ব্যবসা করতে পারবে না। কিন্তু নগরীতে মানা হচ্ছে না এ নিয়ম। যেসব প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবের সদস্য নয়, তাদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করতে পারে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। আবার চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যাতে তাদের নকশা অনুমোদন না করতে পারে। তাহলে এমন প্রতারণা কমে আসবে। আস্তে আস্তে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে।’
আবদুল কৈয়ূম চৌধুরী আরও বলেন, ‘চট্টগ্রামে দুই শতাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮১টি প্রতিষ্ঠান রিহ্যাবের সদস্য। নানা অভিযোগ যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আসে, খোঁজ নিলে দেখা যায় তারা কেউ রিহ্যাবের সদস্য নয়। প্লট ও ফ্ল্যাট কেনার আগে গ্রাহকরা যেন দেখেন প্রতিষ্ঠানটি রিহ্যাবের সদস্য কিনা, তাহলে প্রতারিত হবেন না। রিহ্যাবের সদস্য হলে একটি আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হয়। সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রিহ্যাবে অভিযোগ করার সুযোগ থাকে। রিহ্যাবও অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
ঠিক সময়ে ফ্ল্যাট বুঝে না পাওয়া, জমি বুঝে নেওয়ার পরও ঠিক সময়ে কাজ শুরু না করা, আবাসন প্রতিষ্ঠানকে চাপে ফেলে অনায্যভাবে টাকা আদায়ের অভিযোগসহ ছোট-বড় নানা অভিযোগ নিয়মিতই আসতে থাকে রিহ্যাব কার্যালয়ে। এসব অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য রিহ্যাবের আছে ‘কাস্টমার কেয়ার ও মেডিয়েশন সেল’। যদিও বিরোধ নিষ্পত্তি ও সদস্যপদ বাতিলের ক্ষমতা ছাড়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আর কোনো ক্ষমতা নেই আবাসন ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ সংগঠনটির। অবশ্য রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী, বিভিন্ন অপরাধের দায়ে রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ আইনে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে ক্রেতা ও ডেভেলপারের মধ্যকার বিরোধ আপসের মাধ্যমে সমাধানের বিধান করা হয়েছে। সেই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য রিহ্যাব ওই সেল গঠন করে।
চট্টগ্রামের বায়েজীদ থানাধীন রূপাবাদ এলাকায় শাহ আমানত টাওয়ারের নির্মাণকারী ডেভেলপার আহমদ কবিরের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন ফ্ল্যাট মালিকরা। ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট রাশেদা বেগম থেকে পাঁচলাইশ মৌজার আন্দর ১২০৭৫ নম্বর চুক্তিনামামূলে চুক্তির হয়ে ও একই তারিখের ১২০৭৬ নম্বর আমমোক্তারমূলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তপশিলোক্ত সম্পত্তি উন্নয়নপূর্বক জমিতে শাহ আমানত টাওয়ার নামে ৯ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন ডেভেলপার আহমদ কবির। বিভিন্ন আয়তনের ৪০টি ইউনিটের ফ্ল্যাটের মধ্যে তখন প্রায় ২৯টি ফ্ল্যাট পৃথক রেজিস্টার্ড দলিলমূলে বিভিন্ন দামে আগ্রহী ফ্ল্যাট মালিকদের কাছে বিক্রয় করেন তিনি। ফ্ল্যাট মালিকদের কেউ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষক, কেউবা ইঞ্জিনিয়ার, আবার কেউ ব্যাংকে চাকরি বা ব্যবসায়ী। ফ্ল্যাট কিনে শান্তিতে নেই ফ্ল্যাট মালিকরা। তবে ডেভেলপার আহমদ কবিরের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে কিছু ফ্ল্যাট মালিক। টাওয়ারের ভেতর দিয়ে ১৫ ফুট রাস্তা থাকলেও পার্কিং স্পেস ২১টাই আছে। অনেক কথা মিথ্যা বলছে তারা। ২০১৭ সালে এমন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এলেও এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি তা।
নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেওয়া, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারসহ আরও কিছু বিষয়ে রিহ্যাবের কাছে অভিযোগ আসছে বলে জানান রিহ্যাব চট্টগ্রাম রিজিওনাল কমিটির কো-চেয়ারম্যান মাহবুব সোবহান জালাল তানভীর। তিনি বলেন, ‘রিহ্যাবের কাছে অভিযোগ আসার পর আমাদের বিশেষ টিম সেটি খতিয়ে দেখে। অনেক সময় মিথ্যা অভিযোগও আসে। তাই এ-সংক্রান্ত সেল সব নথিপত্র যাচাই করে সিদ্ধান্ত দেয়। আগের তুলনায় প্রতারণার হার কিছুটা কম।’
ফ্ল্যাট কিনে প্রতারণার শিকার হওয়া প্রবাসী সিরাজুল ইসলাম বলেন, সাত বছর আগে চুক্তির সব টাকা দেওয়ার পরও ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিতে পারেনি তামান্না বিল্ডার্স। বিচার চেয়েও পাইনি কোথাও। শেষ পর্যন্ত নিজের টাকায় নির্মাণকাজ করে কোনোমতে বসবাস করছি।
এইদিকে গত বৃহস্পতিবার হোটেল র্যাডিসন ব্লু বে ভিউতে চার দিনব্যাপী রিহ্যাব ফেয়ার শুরু হয়েছে। চার দিনব্যাপী রিহ্যাব ফেয়ার উদ্বোধন করেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম ও রিহ্যাব চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরীসহ অন্যরা – মো. রাশেদ
গতকাল বৃহস্পতিবার হোটেল র্যাডিসন ব্লু বে ভিউতে চার দিনব্যাপী রিহ্যাব ফেয়ার উদ্বোধন করেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রামের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম ও রিহ্যাব চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আবদুল কৈয়ূম চৌধুরীসহ অন্যরা।