আশিফুজ্জামান সারাফাত
রমজানের পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে একে একে ভিড়ছে জাহাজ। এরই মধ্যে চাহিদার চেয়ে বেশি এসেছে ছোলা ও ডাল। চিনি, খেজুরও এসেছে পর্যাপ্ত। সয়াবিন কিছুটা কম এলেও পাইপলাইনে আছে ভোজ্যতেলের জাহাজও। গত বছরের শেষ দিকে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে, সেগুলো এরই মধ্যে এসে গেছে বন্দরে। জানুয়ারিতে যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে– এখন আসছে সেসব পণ্য। ২৩ কিংবা ২৪ মার্চ থেকে শুরু রমজান। এর আগেই পাইপলাইনে থাকা বাকি পণ্য দেশে এসে পৌঁছাবে বলে ধারণা করছেন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রামের পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জে কিছু পণ্যের দাম এখন বাড়তি থাকলেও রমজানের আগে তা পড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
রমজান ঘিরে দেশে পর্যাপ্ত ভোগ্যপণ্য এসেছে বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, ‘রমজানের পণ্য নিয়ে এখন আর কোনো শঙ্কা নেই। অনেক পণ্য এসে গেছে। পাইপলাইনে আছে আরও বিপুল পরিমাণ পণ্য।
রমজানের আগে সেসব পণ্যও এসে পৌঁছাবে। ডলার নিয়ে যে সংকট ছিল, তাও কেটে যাচ্ছে। আশা করি, রমজানে ভোগ্যপণ্যের দামও হাতের নাগালে থাকবে।’
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘রমজান ঘিরে পর্যাপ্ত পণ্য আমদানি হয়েছে দেশে। পাইপলাইনে থাকা পণ্য যদি রমজানের আগে বাজার ধরতে পারে, তাহলে কোনো সংকট তৈরি হবে না। যেসব পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে, সেগুলো যাতে ডলার নিয়ে সংকটে না পড়ে– সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে মন্ত্রণালয়কে। চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে রমজানে নিয়ন্ত্রণে থাকবে পণ্যের দামও।’
ছোলাসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপ। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বুধবার অনুষ্ঠিত বৈঠকে বলেন, গত রমজানে আমরা ৬৬ টাকায় ছোলা বিক্রি করেছি। এবার সেটির দাম ৮০ থেকে ৮২ টাকা। গতবার প্রতি ডলার ৭৯ টাকা দরে ডলার আমদানি মূল্য পরিশোধ করেছি। এবারে পরিশোধ করতে হয়েছে ১০৫ টাকা দরে। ডলারের কারণে এবার ছোলাতে ২৫ শতাংশ দাম বাড়তি।
তবু বাড়ছে ছোলার দাম: দেশে ছোলার চাহিদা বছরে ১ লাখ ৫০ হাজার টন। এর মধ্যে শুধু রমজানে চাহিদা থাকে এক লাখ টন। এই চাহিদার বিপরীতে প্রায় দুই লাখ টন ছোলা আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৪ হাজার ৬০০ টন।
চাহিদার চেয়ে বেশি ছোলা মজুত থাকলেও গত দুই মাসে অসাধু ব্যবসায়ীরা কয়েক দফায় পণ্যটির দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়েছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন বাজারে এখন খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়, যা এক মাস আগেও ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি কম হলেও ভারত থেকে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ছোলা দেশে ঢুকছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী। পাইকারি মোকাম খাতুনগঞ্জে ভালো মানের ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়। কিন্তু খুচরাতে গিয়ে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে যাচ্ছে ছোলার দাম।
মসুর ডালের রেকর্ড আমদানি : মসুর ডাল আমদানি করে এবার রেকর্ড গড়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। গত ছয় মাসে প্রায় আড়াই লাখ টন মসুর ডাল আমদানি করেছেন তাঁরা। এটি ২০২১ সালের একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। এর পরও বাজারে মসুর ডালের দাম বাড়তি। শুধু যে বাড়তি এসেছে, তা নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারেও মসুর ডালের দাম ক্রমাগত কমছে। তবু এ পণ্যের প্রত্যাশিত সুফল দেখা যাচ্ছে না পাইকারি ও খুচরা বাজারে। অথচ দেশে বছরে মসুর ডালের চাহিদা ছয় লাখ টন। এর মধ্যে ২ লাখ ২০ হাজার টন দেশেই উৎপাদিত হয়। বাকি প্রায় চার লাখ টন আমদানি করা হয়। বছরজুড়ে মসুর ডালের চাহিদা মাসে ৪০ হাজার টন থাকলেও রমজানের এক মাসে চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ টনে। শেষ দুই মাসে দেশে এসেছে আরও প্রায় ২৫ হাজার টন মসুর ডাল। পাইপলাইনেও আছে মসুর ডালের একাধিক জাহাজ। তবু কেন মসুর ডালের দাম কমছে না, তা জানা নেই কারোরই। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে এখন মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে সর্বনিম্ন ৮৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৩০ টাকায়। এক মাস আগের চেয়ে দাম বেড়েছে কেজিতে তিন থেকে পাঁচ টাকা।
চট্টগ্রাম ডাল মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ দে জানান, মসুর ডাল গোটা আকারে আমদানি হয়। এরপর ক্রাশিং মেশিনে প্রক্রিয়াজাত করে সেটি খাওয়ার উপযোগী করা হয়। এভাবে ক্রাশিং করতে ৫ থেকে ৬ শতাংশ ডাল কমে যায়। তবু এখন যে দামে ডাল বিক্রি হচ্ছে, তা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।
পর্যাপ্ত এসেছে খেজুরও: বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) হিসাবে, দেশে সারাবছর খেজুরের চাহিদা থাকে প্রায় এক লাখ টন। শুধু রমজানে এই চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় ৪৫-৫০ হাজার টন। এই চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত খেজুর এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে দেশে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্র বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয়েছে ৯১ হাজার ৯০৪ টন। তবে এই অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খেজুর আমদানি হয়েছে প্রায় ৬০ হাজার টন। তবু রোজা ঘিরে আগেভাগেই বেড়ে গেছে খেজুরের দাম। পাঁচ কেজির কার্টনে খেজুরের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ৭০০ টাকারও বেশি।
সরবরাহ বাড়ছে চিনিরও : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে চিনির মোট চাহিদা থাকে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন। আখ থেকে চিনির উৎপাদন ৩০ হাজার টন। বাকিটা আমদানি করেই মেটানো হয়। প্রতি মাসে গড়ে চিনির চাহিদা দেড় লাখ টন থাকলেও রমজানে চিনির চাহিদা বেড়ে তিন লাখ টন হয়। গত সাত মাসের আমদানি চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাহিদার কাছাকাছি চিনি আমদানি হয়েছে দেশে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি কিছুটা কম থাকলেও গত দুই মাসে চিনির সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে।
ভরসা পাম অয়েল : দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা বছরে ২০ লাখ টন। এর প্রায় পুরোটাই আমদানি করতে হয়। রমজানে তেলের চাহিদা থাকে প্রায় তিন লাখ টন। এর বেশিরভাগই পাম অয়েল। এবার পরিশোধিত পাম অয়েল রেকর্ড আমদানি হয়েছে। ২০২২ সালের ছয় মাসে আমদানি হয়েছে সাড়ে ৯ লাখ টন; গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি ১৪৩ শতাংশ। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসে দেড় লাখ টন পাম অয়েল আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে।