ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি:
ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলা থেকে নয় কিলোমিটার গফরগাঁও সড়কে সুতিয়া নদীর পাশ দিয়ে একটি মহল্লা চন্দরাটি (পালপাড়া)। এ গ্রামে কয়েক হাজার পাল বংশ শান্তিপূর্ণভাবে শত শত বছর যাবত বসবাস করে আসছে। তাদের পেশা ছিল বাংলাদেশের সব চেয়ে পুরাতন শিল্পের মধ্যে মৃৎশিল্প উল্লেখযোগ্য। প্রাচীনতম থেকেই মৃৎশিল্পের কারিগরেরা কুমার বা পাল নামে বংশ পরিচয় হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। শত শত বছর যাবত এ পেশার সঙ্গে জড়িত কারিগররা তাদের গভীর ভালোবাসা আর মমতা দিয়ে সুনিপুন হাতের বিভিন্ন কারুকাজের মাধ্যমে মাটি দিয়ে তৈরি করেন নানা ধরণের তৈজসপত্র।
বর্তমান যুগে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই মৃৎশিল্পটি আজ হারিয়ে যাচ্ছে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে মাটির তৈরি এসব জিনিসের বদলে বাজার দখল করছে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল ও সিরামিকসহ অন্য সব সামগ্রী। তাই আধুনিক প্রযুক্তির তৈজসপত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মাটির তৈরি অনেক পণ্যই হারিয়ে গেছে। কিন্তু মাটির তৈরি কিছু তৈজসপত্র এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। শহরবাসীর দালান-কোটা সাজাতে মাটির তৈরি নানা পট-পটারি, ফুলদানি ও বাহারি মাটির হাঁড়ির কদর রয়েছে এখনো।
সরজমিন জানা যায়, ভালুকা উপজেলা বিরুনিয়া ইউনিয়নে চান্দরাটি পালপাড়া গ্রামের সুকুমার পাল (৬৫) ছোট কাল থেকেই মৃৎশিল্পের কাজ করে আসছেন। তিনি বলেন মৃৎশিল্পের দাপট ও কদর দুটোই ছিল। ছোট সময় আমাদের এলাকার প্রায় ৭ শত পরিবার মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করত। ওই সময় উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটির তৈরি এসব তৈজসপত্র সরবরাহ করা হত।
বর্তমানে ওই এলাকার মৃৎশিল্পের সঙ্গে এখনো জড়িত রয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার। তারা বিভিন্ন উৎসবসহ মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন এখনো। তাই এখানে পুরুষ মৃৎশিল্পীর পাশাপাশি নারীরাও সমানতালে কাজ করছেন।
আগের মতো চাহিদা আর পারিশ্রমিকের ন্যায্য মূল্য না থাকায় এ পেশার লোকজন অত্যন্ত দুঃখ-দুর্দশা আর হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় অন্য পেশায় তেমন খাপ খাওয়াতে পারছেন না তারা। কম লাভ জেনেও শুধু পারিশ্রমিকের আসায় বাপ-দাদার পুরানো ঐতিহ্য ধরে রাখতে এখনো মাটি দিয়ে তৈরি করছেন বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি, সরা, কলস, বাসন, মুড়ি ভাজার খোলা, কোলা, ভাটি, পিঠা তৈরির খাঁজ, জালের কাঠি, মাটির ব্যাংক ও জলকান্দা ইত্যাদি।
ভালুকা উপজেলার বিরুনিয়া ইউনিয়নের চান্দরাটি পালপাড়াতে ঢুকলেই চোখে পড়ে তাদের কষ্টের জীবনযাত্রা। সারা এলাকায় যেন লেগে আছে শত কষ্ট আর অভাবের দৃশ্য। মাটি সোনার চেয়েও খাঁটি। মাটির সামগ্রীতে মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখের অনুভূতি, প্রেম-বিরহের নানা দৃশ্যপট, মনোমুগ্ধকর ছবি হাতের স্পর্শে ফুটিয়ে তুলতেন শিল্পীরা। অথচ আজ উপজেলা বিভিন্ন এলাকায় এখন পুঁজির অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এখানকার মৃৎশিল্প। এই পেশায় এখন ভর করেছে অভাব-অনটন। মেলা-পার্বনেও তেমন চাহিদা নেই মাটির তৈজসপত্রের। তবে কিছু হোটেল-মিষ্টির দোকানে এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পূজায় এখনও প্রয়োজন হয় মাটির সামগ্রীর। পহেলা বৈশাখে মাটির সরাইয়ে (সানকি) তে পান্তাভাত খাওয়ার রীতিও চালু আছে।
একটা সময় ছিল বাংলা নববর্ষকে ঘিরে নির্ঘুম ব্যস্ত সময় পার করতেন চান্দরাটি পালপাড়ার মৃৎশিল্পীরা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষ। নববর্ষ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বসে বর্ষবরণ মেলা। সেই মেলায় চাহিদা থাকে নানা রকমের খেলনা, মাটির জিনিসপত্রের। মেলাকে দৃষ্টিনন্দন করতে মৃৎশিল্পীরা নিজের হাতে নিপুণ কারুকাজে মাটি দিয়ে তৈরি করতেন শিশুদের জন্য রকমারি পুতুল, ফুলদানি, রকমারি ফল, হাঁড়ি, কড়াই, ব্যাংক, বাসন, থালা, বাটি, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, টিয়া, ময়না, ময়ূর, মোরগ, খরগোশ, হাঁস, কলস, ঘটি, চুলা, ফুলের টবসহ মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র।
শ্রী আসুত্তর চন্দ্র পালের স্ত্রী হেমবালা (৬০) জানান, ৫০ বছর যাবত থেকেই এই মাডির কাম করতাছি, স্বামীর কমড়ে ৮ বছর ধইরা বেথা, দুই মেয়ে, টেহা পয়সা নাই, আগে মাটি কিনুন লাগতোনা এহন মাডি কিনুন লাগে, এক গাড়ী পনের থেকে দুই হাজার টেহা।
শ্রীমতি শেফালী চন্দ্র পাল (৫০) জানান, আমার ১ মেয়ে, ২ ছেলে, রঞ্জিত স্বর্ণের কাম করে, রোদ্র ৭ম শ্রেণীতে পড়ালেহা করে সাহেরা সাফায়েত স্কুল এন্ড কলেজে, কষ্টের সংসার, অনেক ঠান্ডা, কনকনে শীতে মাডির কাম করবার আর মন চাইনা, কি করুম সংসারতো চালান লাগবো।
টস টস শব্দ শোনে অন্য এক বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখা গেলা এক মহিলা মৃৎশিল্পের কাজ করছে, নাম জিজ্ঞাসা করলে বলেন, আমার নাম শোভা, বয়স ৬০, আমার স্বামী আমাকে বিয়া কইরা কই গেছেগা ২০/২৫ বছর আগে, আমার কোন পুলাপাইন নাই, একা একা থাকি আর মাডির কাম করি, কয়েকবার গেলাম একটা বয়স্ক ভাতা টেহা পাউনের লাগাইয়া কিছু পাইলাম না।
শ্রী সুকুমার পাল জানান, বর্ষা মৌসুমে আমরা চরম ভোগান্তিতে পড়ি। কাঁচামাল রোদে শুকাতে হয়। বারবার বৃষ্টি আসাতে তেমন শুকানো যায় না। বাজারও থাকে খুব খারাপ তেমন বেচাকেনাও হয় না। অর্ধ হারে অনাহারে আমাদের জীবন চলে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো জানান, কুমোররা কীভাবে বেঁচে আছে, তারা কী তাদের পারিশ্রমিক অনুযায়ী ন্যায্যমূল্য পায় কিনা এ খোঁজখবর রাখার কেউ নেই। কেউ জানতেও চান না আমাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধার কথা।
এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকার সংশি¬ষ্টরা যদি যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে একসময় মৃৎশিল্পটি বন্ধ হয়ে যাবে। মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন সুশিল সমাজের লোকজন।