এএইচএম তারেকুজ্জামান ফাইন প্রধান লালমনিরহাট জেলা প্রতিনিধি :-
মাদক দিয়ে ফাঁসিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘু এক ব্যবসায়ীর কাছে দুই দফায় ১৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে লালমনিরহাট সদর থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) ও বর্তমানে জেলার আদিতমারী থানায় কর্মরত সেলিম রেজার বিরুদ্ধে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় অভিযুক্ত এসআই সেলিম রেজাসহ তার সহযোগী লালমনিরহাট থানার এএসআই আতাউল গণি প্রধানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি বিভাগীয় মামলাও রুজু হয়েছে।
বিভাগীয় মামলায় অভিযোগকারীসহ অন্যান্য স্বাক্ষীরা স্বাক্ষ্য দিতে যাওয়ায় পুনরায় দুই দফায় অভিযোগকারীসহ অন্য স্বাক্ষীদের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী সংখ্যালঘু ওই ব্যবসায়ী। এ বিষয়ে তিনি গত ২১ জুলাই রংপুর ডিআইজি অফিসে উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তা চেয়ে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাট শহরের গোশলা বাজারে মাছের আড়ত ও পরিবহন ব্যবসা করে আসছেন শহরের রামকৃষ্ণ মিশন রোডের বাসিন্দা সুজিত কুমার ভদ্র। ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে মাছের পাইকারদের নিকট টাকা কালেকশন করে তার ম্যানেজার ও কর্মচারীসহ মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফেরার সময় রাস্তা থেকে তাদের ৩ জনকে আটক করেন এসআই সেলিম রেজা, সোর্স আবুল কালামসহ অপর দুজন পুলিশ সদস্য। তাদের আটক করে নিয়ে আসা হয় ব্যবসায়ী সুজিতের গরুর খামারে। সেখানে তাদের ঢুকিয়েই মোবাইল কেড়ে নিয়ে হাতে হাতকড়া পড়িয়ে চড় থাপ্পর মেরে বলতে থাকেন মাদক কোথায় রাখছিস বল। এমন কথা শুনে ব্যবসায়ী সুজিত বলেন, কিসের মাদক কোথায় মাদক আমাকে এসব বলছেন কেন? তখন এসআই সেলিম রেজা তার সোর্স কালামকে একটি স্থান দেখিয়ে বলেন, ওখানে মাটি খুঁড়ে দেখ কিছু আছে কি না। সোর্স কালাম হাত দিয়ে মাটি সরিয়ে একটি ব্যাগ তুলে বলেন, গাজাঁ পাওয়া গেছে। পরে এসআই সেলিম রেজা গরুর খাওয়ার খড়ের পুঞ্জে হাত ঢুকিয়ে একটি প্যাকেট বের করে বলেন এখানে ইয়াবাও রেখেছিস। এরপর ব্যবসায়ী সুজিতকে আরও কয়েকটি চড় মেরে কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে এখন তুই মাদক কারবারি হিসেবে গুলি খাবি নাকি এখানে এই মুহূর্তে ২০ লাখ টাকা দিবি? এভাবে মানসিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে সুজিত তার মোবাইল চাইলে সেলিম রেজা ৩০ মিনিট সময় বেঁধে দিয়ে ২০ লাখ টাকা আনাতে বলেন, নইলে রাতেই তাকে ক্রসফায়ার করার কথা জানান। এতে ভয় পেয়ে ব্যবসায়ী সুজিত তার স্ত্রীকে ফোন করে টাকা চেয়ে তার জীবন বাচাঁনোর আকুতি জানালে তার স্ত্রী জানায় মাছের টাকা টিটি করার জন্য রাখা ৪ লাখ ৫০ হাজার আছে। এসময় গয়না দিতে চাইলে এসআই সেলিম রাজি না হয়ে ক্যাশ টাকা ছাড়া হবে না বলে জানায়। ফলে তার স্ত্রী স্বামীর জীবন বাচাঁতে রাতেই আত্মীয়স্বনদের নিকট আরও কিছু টাকা যোগাড় করে মোট ৮ লাখ টাকা সুজিতের ছোট ভাইকে দিয়ে খামারে পাঠালে এসআই সেলিম সেই টাকা নিয়ে দ্রুত তার সোর্সকে দিয়ে বলে রেখে আস। এরপর ২০ লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ কমিয়ে ১৫ লাখ টাকা দাবি করে বাকি ৭ লাখ পরে দেওয়ার কথা বলে তাদের ছেড়ে দিয়ে গাঁজা ও ইয়াবা নিয়ে চলে যায় সেলিম রেজা অন্যদের নিয়ে।
এর কিছুদিন পর ওই ৭ লাখ টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে সেলিম রেজা ও সোর্স কালাম। কিন্তু সুজিত তাদের জানায় আর দিতে পারবে না। তবুও হাল ছাড়েনি এসআই। প্রতিদিন তার সোর্সকে মাছের আড়তে পাঠাতে থাকে এবং ভয় দেখাতে থাকে। একপর্যায়ে আরও ৪০ হাজার টাকা সুজিত সেলিম রেজাকে দিয়ে বলে এখন গুলি করলেও আর একটি টাকাও দিতে পারবেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সেলিম রেজা। পরে কয়েকমাস চুপচাপ থাকার পরে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১ টার দিকে ব্যবসায়ী সুজিতের মোবাইলে তার ট্রাক চালক ফোন করে জানায়, এসআই সেলিম তিস্তা সেতু টোল প্লাজায় ট্রাক আটক করে তাকে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে। ট্রাকে গাজা পাওয়া গেছে। আপনি ২০ লাখ টাকা নিয়ে আসলে ট্রাক ও আমাকে ছেড়ে দিবে । না হলে মামলায় আপনাকেও আসামী করে ক্রসফায়ার করবে। আপনি এখনই আসেন।
এভাবে একাধিকবার ফোন আসতে থাকায় এক পর্যায়ে ব্যবসায়ী সুজিত বলেন কোথায় আসতে হবে। তখন ড্রাইভার জানায়, সদর উপজেলার কদম তলা বাজারের পাশে। পরে ব্যবসায়ী সুজিত ওই মধ্যরাতেই তার মাছের টিটি করার ৮ লাখ টাকা নিয়ে ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে উল্লেখিত স্থানে পৌঁছা মাত্রই এসআই সেলিম মোটরসাকেলের চাবি ও মোবাইল দুটি নিয়ে বন্ধ করে রেখে টাকা চায়।
তখন সুজিত বলেন ৮ লাখ টাকা এনেছি আর দিতে পারব না। তখন সেলিম টাকা নিয়ে বলেন, তোর সঙ্গে আরও কথা আছে, এখানে অপেক্ষা কর আমি যাব আর আসব বলে তার ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল নিয়ে শহরের দিকে চলে যান এবং প্রায় ১ ঘন্টা পর ফিরে এসে বলেন, চল ট্রাকের কাছে যাই ট্রাক ছেড়ে দিব। সরল বিশ্বাসে সুজিত ও ম্যানেজার তার সঙ্গে কিছুদূর এগিয়ে ট্রাকের কাছে যাওয়া মাত্রই ট্রাক থেকে নেমে আসে তিস্তা টোল প্লাজার চেক পোস্টের দায়িত্বে থাকা এএসআই আতাউল গনি প্রধান। এরপর সুজিত কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে পাজাকোলা করে ট্রাকের কেবিনে চালকের সঙ্গে বসিয়ে এসআই সেলিম পাশে বসে সুজিতের কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে এএসআই আতাউল গনিকে সুজিতের মোটরসাইকেল চালিয়ে আসতে বলে এবং তার নিজের মোটরসাইকেল অপর এক সিভিল অজ্ঞাত লোককে চালিয়ে আসতে বলে ট্রাক চালককে বলেন খুব ধীরে ট্রাক চালাতে। এসময় সুজিতের ম্যানেজার আলাউদ্দিন দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপর সেলিম রেজা সুজিতকে বলেন আরও ৭ লাখ দিতে হবে তোকে। সময় ট্রাক থানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত। না হলে আজ ভোরেই তোকে ক্রসফায়ার করব। এসময় সেলিম আরও বলে শালা মালাউন তুই মাছের ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসা করিস এটা প্রমাণ করতে তোর ট্রাকই যথেষ্ট। যেহেতু ট্রাক তোর তুই মাদক কারবারি এবং তোকে আজানের আগেই ক্রসফায়ার করব । প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সুজিত মোবাইল চাইলে এসআই সেলিম রেজা মোবাইল অন করে দিয়ে দেয়। তখন সুজিত তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে কান্নাকাটি করে বলতে থাকে আমাকে বাচাঁও। আরও টাকা যোগাড় কর কোথায় পাও না হলে আজ আমাকে মেরেই ফেলবে। উপায় না পেয়ে সুজিতে স্ত্রী মাঝ রাতেই ছুটে যায় বোনের বাড়িতে এবং ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা যোগার হয়েছে বলে জানালে সেলিম রেজা ওই টাকা নিয়ে শহরের পুরাতন সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে। এরপর সেলিম রেজা এএসআই আতাউল গনিকে বলে ওখানে যেয়ে টাকা নিয়ে সুজিতের গাড়ি রেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে। কথামত এস আই
আতাউল গনি পুরাতন সিনেমা হলের সামনে দাঁড়ালে সুজিতের স্ত্রী তার হাতে টাকা তুলে দেন। টাকা নিয়ে রাস্তার ওপরে মোটরসাইকেল রেখে আড়ালে দাঁড়িয়ে ফোনে টাকা পাওয়ার কথা জানালে পোড়া বটের তল নামক স্থানে সুজিতকে নামিয়ে দিয়ে ট্রাক চালককে নিয়ে পুরাতন সিনেমা হলের সামনে এসে আতাউল গনিকে ট্রাকে তুলে নিয়ে ফজরের আজানের পর থানায় ঢুকেন এসআই সেলিম রেজা। এ ঘটনায় চালককে আসামী করে ২০ কেজি গাজা উদ্ধার দেখিয়ে মামলা দায়ের করেন। সেই সঙ্গে ব্যবসায়ী সুজিতকে ফোন করে বলে, তুই কয়েকদিনের জন্য লালমনিরহাটের বাইরে চলে যাবি, থাকলে সমস্যা হবে।’ এভাবে দুই দফায় ১৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে যান ব্যবসায়ী সুজিত । তখন উপায় না পেয়ে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি দুটি ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে লালমনিরহাট পুলিশ সুপার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ব্যবসায়ী সুজিত।
অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই তারিখেই সদর থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করেন পুলিশ সুপার। এরপর অভিযোগের তদন্তভার ন্যস্ত করেন সদর সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম শফিকুল ইসলামকে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ঘটনা দুটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এবং এর আলোকে প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। ফলে এসআই সেলিম রেজা ও এএসআই আতাউল গনি প্রধাণের নামে গত ১৬ জুনের দুটি বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। সেই বিভাগীয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হেড কোয়ার্টার আতিকুল হক। এদিকে এই বিভাগীয় মামলা চলাকালীন এসআই সেলিম রেজাকে আদিতমারী থানায় পদায়ন করা হলে সে আরও বেপোরোয়া হয়ে উঠে। একপর্যায়ে স্বাক্ষীদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে স্বাক্ষ না দেওয়ারও চেষ্টা করে ব্যর্থ হন এসআই সেলিম রেজা। পরবর্তীতে গত ৫ জুলাই বিভাগীয় মামলায় স্বাক্ষ্য দিতে গেলে পুলিশ অফিসের ভিতরইে সুজিত, ম্যানেজার আলাউদ্দিন ও ট্রাক চালক লোকমানকে দেখে হুমকি দিয়ে সেলিম রেজা বলে,‘আমি আবারও থানায় গিয়েছি, তোদের সবাইকে দেখে নিব।’
এরপর পুনোরায় গত ২০ জুলাই স্বাক্ষ্য শেষে এসআই সেলিম সুজিতের স্ত্রী, ম্যানেজারকে পুলিশ অফিসের করিডোরেই বলেন, এবার সুযোগ পেলেই তোর বসকে ওপরে পাঠিয়ে দিব। শুধু তাই নয় অভিযোগের প্রথম তদন্তকারী কর্মকর্তা সাবেক সার্কেল এসপি ও বর্তমানে পঞ্চগড় জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম শফিকুল ইসলাম সর্ম্পকে আপত্তিকর মন্তব্য করে হুমকি দেয় সেলিম রেজা। তখন ভয় পেয়ে তাৎক্ষনিক ভাবে পুলিশ অফিসের নিচ থেকেই রংপুর রেঞ্জের ডিআইজিকে ফোন করে জানান ব্যবসায়ী সুজিত। এরপর ২২ জুলাই ডিআইজির সঙ্গে দেখা করে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করে নিজের, পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য স্বাক্ষীদের নিরাপত্তা চান তিনি।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ী সুজিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন,‘টাকার চেয়ে জীবন বড়, তাই আমি দুইবার জীবন বাঁচাতে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমার পিছু ছাড়ছিল না। তাই জীবন বাচাঁতে অভিযোগ করেছি এবং আমার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বিভাগীয় মামলা চালু হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে সে বারবার হুমকি দিচ্ছে। বিষয়টি ডিআইজিকে জানিয়েছি এবং দেখা করে লিখিত অভিযোগ দাখিল করে নিরাপত্তা চেয়েছি। আমি ন্যায় বিচার চাই এবং আমার কষ্টের টাকা ফেরৎ চাই।
অভিযুক্ত এসআই সেলিম রেজা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেন, আমি কাউকে ক্রস ফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা নেইনি এবং হুমকিও দেইনি।’ তাহলে আপনার নামে বিভাগীয় মামলা কেন হল জানতে চাইলে তিনি বলেন এটা ডির্পাটমেন্টাল বিষয়। অপর অভিযুক্ত এএসআই আতাউল গনি প্রধান সাংবাদিকদের বলেন,‘এসব বিষয়ে তিনি জড়িত না। এর বাইরে আর কোনও কথা বলতে রাজি হননি তিনি।’
সাবেক সার্কেল এসপি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন,‘ তিনি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন এবং সেই আলোকেই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন বলেই তার নামে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়েছে। এ বিষয়ে লালমনিরহাট পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা বলেন, অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে মামলা রুজু হয়েছে। মামলার বিচার চলমান রয়েছে। অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি হবে।
Like this:
Like Loading...
Related
এ জাতীয় আরো খবর..