টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলা বাংলাদেশে বনাঞ্চলের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। মধুপুরের ভাওয়াল গড় ও শালবন ছাড়াও বিভিন্ন গাছপালা মধুপুর কে ডেকে রেখেছে সবুজের সমারোহে। কিছুদিন আগেও অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলো কৃষিতে সমৃদ্ধ এ উপজেলাটি।এর অন্যতম কারণ ছিলো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। এখানে মোট জনসংখ্যার বেশির ভাগই ছিলো বিদ্যুতের আওতার বাইরে।যেখানে যেখানে বিদ্যুৎ ছিলো সেখানে বিদ্যুৎ যেতোই না বরং মাঝে মাঝে আসতো এমন অবস্থা।
বর্তমান সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সারাদেশের ন্যায় মধুপুর উপজেলাও শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসেছে।
বর্তমানে উপজেলাটিতে পল্লী বিদ্যুতের আওতায় প্রায় ১২শ কিলোমিটারে সম্প্রসারিত হয়েছে বিদ্যুৎ লাইন।
গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজারের বেশি।বিদ্যুতের সম্প্রসারণের ফলে অন্ধকার দূরে ঠেলে একদিকে যেমন আলোকিত করেছে।অন্যদিকে সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে সমৃদ্ধ করেছে এ এলাকার কৃষি খাতকে।
বনাঞ্চল নির্ভর এলাকা হওয়ায় এখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা ছিলো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মধুপুর উপজেলার মোট এগারোটা ইউনিয়ন এবং পৌরসভা একটি।এই বিশাল এরিয়া জুড়ে বিস্তৃত ১২শ কিলোমিটার বিদ্যুতের লাইন এবং প্রায় ৮০ হাজার গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে নিয়োজিত মাত্র ১৫ জন লাইন ম্যান।এই ১৫ জনের গেরিলা বাহিনীই দিনরাত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে সারা উপজেলায়।
দেশে করোনার প্রকোপ দেখা দেয়ার পর থেকে পল্লী বিদ্যুতের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।সারাদেশে যখন লকডাউন চলছিলো,করোনা আতংকে ঘরের বাইরে বের হতোনা কেউ।তখনও নিজের নিরাপত্তার কথা না ভেবে,জীবন বাজী রেখে দিয়ে গেছেন নিরবচ্ছিন্ন সেবা।এদের কারো পরিবারের কেউ অসুস্থ হলেও মিলতোনা ছুটি।এমনকি ঈদের আনন্দের সময়ও সবাই আপনজন থেকে ছিলো বিচ্ছিন্ন।ঝড় বৃষ্টি যেন এদের নিত্য সঙ্গী।রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে পরিবারের কথা না ভেবে,জীবন বাজী রেখে সেবা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।সেবাই যেন এদের একমাত্র ধর্ম।একদিকে করোনার মহামারী অন্যদিকে বন্যা ও প্রাকৃতিক দূর্যোগ এসব উপেক্ষা করে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে মানবতার সেবায় নিয়োজিত মধুপুর পল্লী বিদ্যুতের এই ১৫ গেরিলা।জীবন বাজী রেখে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে মানবের তরে বিলিয়ে যাচ্ছেন অকাতরে।অথচ এদের এই কষ্ট আর ত্যাগের কোন মূল্যায়ন করেনা কেউ। কখনো কোন পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়না এদের ছবি।লেখা হয়না কোন প্রতিবেদন।
সরজমিনে মধুপুর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রাহকদের প্রতিক্রিয়ায় জানাযায়,প্রায় সব ইউনিয়নেই নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে।আউশনারা ইউনিয়নের শাহাজাদা,আমজাদ হোসেন,মজনু মিয়া সহ আরও অনেকেই বলেন অন্য সময়ের তুলনায় বিগত প্রায় এক বছর যাবত বিদ্যুৎ সরবরাহ অনেক উন্নত হয়েছে।আগের মতো এখন আর দীর্ঘ সময় কারেন্টের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়না
মহিষমারা ইউনিয়নের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসাব আলী,বুলু মিয়া,জাহাঙ্গীর আলম বলেন,আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ সাভাবিক আছে।আগে একটু সমস্যা হলেও অভিযোগ করার পর সমাধান হতে প্রায় তিনদিন লাগতো।এখন রাত ১০/১১টার সময় সমস্যা হলেও ফোন দিলে ১ ঘন্টার মধ্যেই সমাধান করে দেয়।এজন্য তারা মহিষমারা এবং আউষনারা ইউনিয়নের লাইন ইনচার্জ আজাদ জনির প্রশংসা করেন এবং ধন্যবাদ জানান।
এক প্রতিক্রিয়ায় আক্ষেপ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মধুপুর পল্লী বিদ্যুতের এক লাইন ইনচার্জ বলেন,সারাদেশে পুলিশ,ফায়ারসার্ভিস সহ বিভিন্ন বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে কতো লেখালেখি হয় কিন্তু আমরা সবসময় ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাজী রেখে জনগণের সেবা দেই।ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে বন জঙ্গল কাঁদা মাড়িয়ে দিনরাত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছি।অনেক কর্মী দূর্ঘটনায় মারাও যায়।কিন্তু আমাদের কথা কেউ বলেনা।মধুপুরে ২৫জন লাইনম্যান থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১৫ জন।এই ১৫ জনের পক্ষে এই বিশাল এরিয়া কাভারেজ দেয়া কতোটা কষ্টসাদ্ধ কেউ বুঝে?এরমধ্যে আবার কেউ অসুস্থ হলে তখন চাপ আরও বেড়ে যায়।ঝর বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের অনেক সময় গভীর রাতেও কাজ করতে হয়।
এতো কষ্ট করেও আমরা আমাদের প্রাপ্য সম্মান টুকুও পাইনা।করোনা কালীন সময়ে প্রায় সব সরকারি চাকরিজীবিরাই প্রণোদনা সহায়তা পেয়েছে কিন্তু সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করি আমরা অথচ বারতি কোন সুযোগ সুবিধা আমাদের দেয়া হয়না।মারা গেলেও আমাদের পরিবারকে কোন সুযোগ বা সহায়তা দেয়া হয়না।এ কেমন বিচার?আমাদের দুঃখ প্রকাশ করারও কোন যায়গা নেই।সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন এভাবেই জনগণের সেবা করে যেতে পারি।
সত্যিই ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল আলোর গেরিলা মধুপুরের পল্লী বিদ্যুতের কর্মীরা।দেশমাতৃকার সেবায় নিয়োজিত প্রকৃত যোদ্ধাদের বীরত্বকে স্যালুট জানাই।তাদের এই ত্যাগের যথাযথ সম্মান এবং মূল্যায়ন করবে কতৃপক্ষ এটাই প্রত্যাশা করি।
Like this:
Like Loading...
Related
এ জাতীয় আরো খবর..