জন্মের পর থেকে প্রতিটি মানুষকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। সংসার জীবন মানে যুদ্ধক্ষেত্র। তবে কিছু কিছু মানুষের জীবনের সংগ্রাম যেন শেষই হয় না। এমনই এক সংগ্রামী নারী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকার দক্ষিণ ভাদার্তী গ্রামের রথি কস্তা। আজকাল সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ সমানভাবে থাকলেও ঝালমুড়ি বিক্রির কাজে সাধারণত তাদের দেখা যায় না। কিন্তু রথি কস্তা তার বুদ্ধি প্রতিবন্ধি স্বামীর ওপর বুঝা না হয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসারের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়েছেন। প্রথমে কিছু লোক তার এ পেশা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা ও সমালোচনা করলেও অনেকেই আবার তাকে সাহস যুগিয়েছেন এবং সহযোগিতা করেছেন।
রথি প্রতিদিন সকালে ঝাল মুড়ির সরঞ্জাম নিয়ে বিভিন্ন হাট বাজার, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের গেইট, শপিংমলের সামনে রুটিন মাফিক ভ্রাম্যমান দোকান বসিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। তাই অনেকেই ঝাল মুড়ি কিনতে ভিড় করে তার ভ্রাম্যমাণ ঝালমুড়ির দোকানে। রথির বানানো ঝালমুড়ির মান ভালো হওয়ায় দিন দিন তার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। পরিবারে চার সদস্য নিয়ে রথি কস্তার সংসার। ঘরে বসে দোকানের মুড়ি তৈরীর বিভিন্ন পণ্য কাটা বাছাই করে সহযোগীতা করেন তার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী স্বামী। দুই সন্তান লেখাড়ার ফাঁকে বাবা মাকে ব্যবসার কাজে সহযোগিতা করে থাকে।
জীবন যুদ্ধে হার না মানা রথি কস্তা এ প্রতিবেদককে জানান, আমার জন্ম চট্রগ্রামের এক গরীব পরিবারে। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে ঢাকার একটি মিশনারী স্কুলে ভর্তি হয়ে বটমূল হোস্টেলে থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করি। পরবর্তীতে অসুস্থ্য আপন খালাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বক্তারপুর ইউনিয়নের সাতানীপাড়া গ্রামে চলে আসি। দারিদ্রতার কারণে পরে আর লেখাপড়া হয়নি। ২০০৪ সালে পারিবারিক ভাবে কালীগঞ্জ পৌর এলাকার দক্ষিণ ভাদার্তী গ্রামের বুদ্ধি প্রতিবন্ধি পংকজ কস্তাকে বিয়ে করি। বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে সংসারের খরচ জোগানো দায় হয়ে পড়ে। পরে এদিক সেদিক একটি কাজের চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। বুঝতে পারি প্রতিদিন কেউ আমাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। তাছাড়া মানুষের কাছে হাত পেতে খাওয়ার চেয়ে খেটে খাওয়া উত্তম। পরে নিজের চিন্তা থেকে প্রতিবন্ধি স্বামীর আর্থিক সংকট ও জীবন জীবিকার প্রয়োজনে স্বল্প পুঁজি নিয়ে ২০০৭ সাল থেকে বাড়ীর পাশে আড়িখোলা রেল ষ্টেশনে, ট্রেনে চড়ে ঝাল মুড়ি বিক্রি শুরু করি। এখন ট্রেনে প্রচন্ড ভিড় হওয়ায় বয়সের কারণে ট্রেনে উঠতে সাহস পাই না। তাই রেল ষ্টেশন, বিভিন্ন হাট বাজার, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের গেইট, শপিংমলের সামনে ভ্রাম্যমান দোকান বসিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করি। সংসারে স্বামী, দুই ছেলে অরেন কস্তা ও অন্তর কস্তা এবং বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছে আমার। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাজার থেকে পনেরশ টাকার ঝাল মুড়ি বিক্রি হয়। সকল খরচ বাদে দৈনিক ৭/৮শ টাকা লাভ হয়। এতে আমার সংসারের খরচ বহন করতে পারছি। পরে এটাকেই আমি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। কোন কাজকেই ছোট করে দেখতে নেই। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমি নিজের ব্যবসাকে আরো বড় করে গড়ে তুলতে পারব।
ঝাল মুড়ি খেতে আসা ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রথি কস্তা একজন জীবন যুদ্ধে হার না মানা শ্রমজীবি নারী। তার মনের মাধুরী দিয়ে চানাচুর, মুড়ি, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, ছোলা, শসাসহ বিভিন্ন রকম মসলা দিয়ে মুখরোচক মুড়ি মাখিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে চলেছেন। ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়েও তাকে ঝালমুড়ি বিক্রি করেতে দেখা যায়। সারাদিন কর্মব্যস্ততার পরও রথির মুখে সার্বক্ষণিক হাসি লেগে থাকে।