সেই ব্রিটিশ আমল থেকে পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে যে ধারণা বাসা বেঁধেছিল, তা খুব একটা সুখকর নয়। প্রথাগত পুলিশিং নিয়ে জনমানসে মোটাদাগে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে সাধারণ মানুষের কাতার থেকে পুলিশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু গত এক-দেড় দশকে পুলিশ সম্পর্কিত জনধারণা অনেকখানিই বদলে গেছে। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’—এই কথাটি এখন আর নেহাতই কেতাবি কথা নয়। বাস্তবিকই পুলিশ জনগণের বন্ধু হয়ে উঠছে।
জ
এই যুগান্তকারী পরিবর্তনের অন্যতম পুরোধা ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে সরকারি দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বেদে, হিজড়া ও যৌনকর্মীদের মতো একেবারে প্রান্তবর্তী জনগোষ্ঠীকে উত্তরণের পথে নিয়ে আসা এই মানুষটি ডিএমপির কমিশনার হয়েছেন। এটি সেই সকল পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য একটি বড় খুশির খবর।
হাবিবুর রহমানের প্রতিটি অভিনব কাজ স্বীকৃত হয়েছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে, এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেও। তার প্রতিষ্ঠিত উত্তরণ ফাউন্ডেশন বেদে, হিজড়া ও যৌনকর্মীদের নিষ্পেষিত জীবনচক্র ঘুরিয়ে দিতে শুরু করেছে।
পিছিয়ে থাকা বেদে সম্প্রদায়কে সাড়ে চারশ’ বছরের গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্ত করে সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে এনেছেন হাবিবুর রহমান। তার উদ্যোগে সাভারের বেদে পল্লিতে এখন স্কুল হয়েছে। সেখানে বেদে শিশুরা লেখাপড়া শিখতে পারছে। হয়েছে মাদ্রাসা। সেখানে বেদে শিশুরা ধর্মীয় শিক্ষা পাচ্ছে। উত্তরণ ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় একেবারে কোণঠাঁসা বেদে সম্প্রদায় সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্য বয়ে আনার সুযোগ পেয়েছে।
আমাদের মতো ভদ্রলোকের ঘরে জন্ম নেওয়া হিজড়া শিশু একটু বড় হওয়ার পর সমাজের মূলধারা থেকে ছিটকে পড়ে। সেই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারাতে পুনরায় ফিরিয়ে আনার অদম্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন হাবিবুর রহমান।
‘হিজড়া’ কথাটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায় মানুষের মুখ ভেসে ওঠে। কিন্তু তাদের জীবনও এখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
উত্তরণ ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতায় বহু হিজড়া ব্যক্তি এখন মূলধারার জনসাধারণের মতো মার্জিত জীবনযাপন করছেন; কৃষি খাতে সফল খামারি হয়েছেন। সেলুন ও রূপচর্চা কেন্দ্র পরিচালনায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্ট্রিট রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। সংবাদপাঠিকা হিসেবে দেশব্যাপী সাড়া ফেলেছেন। গল্প-উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সভা-সেমিনারে দেশকে তুলে ধরাসহ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে নিজেদের ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করেছেন।
সমাজের চোখে অচ্ছুত যৌনকর্মীরা মারা গেলে তাদের জানাজা পড়ানো হতো না। স্বাভাবিক দাফন হতো না। হাবিবুর রহমান যৌনকর্মীদের সেই মৃত্যু পরবর্তী ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিরল ভূমিকা রেখেছেন। তার একক উদ্যোগের ফলে দৌলতদিয়ার যৌনপল্লিতে এখন যৌনকর্মীদের মৃত্যু হলে তাদের স্বাভাবিক দাফন হয়। অন্য সকলের মতোই মৃত্যুপরবর্তী সৎকর্ম সম্পন্ন হয়। যৌনকর্মীদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়াসহ তাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানদের সামাজিক মর্যাদায় বড় হওয়ার সুযোগ তৈরিতে এখন তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রান্তবর্তী মানুষের জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রেই যে শুধু তিনি অবদান রেখেছেন, তা নয়। বেদে সম্প্রদায়ের অতি বিপন্ন তথা বিলুপ্তপ্রায় ‘ঠার’ ভাষাকে নিশ্চিত হারিয়ে যাওয়ার পথ থেকে তিনি রক্ষা করেছেন। হাবিবুর রহমান আট বছর নিরন্তর গবেষণা করে বেদে জনগোষ্ঠীর ‘ঠার’ ভাষার প্রামাণ্য বিষয়াবলী গ্রন্থবদ্ধ করেছেন। পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ শীর্ষক কোষগ্রন্থটি তিনি রচনা করেছেন। একাডেমিক পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে লেখা এই বইটি একই সঙ্গে বেদে জনগোষ্ঠী ও তাদের ভাষার ইতিহাস ও অভিধান গ্রন্থ।
এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে হাবিবুর রহমান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। গত ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইটির লেখক হাবিবুর রহমানকে এই বিরল সম্মাননা পদক তুলে দেন। বইটির স্বীকৃতিস্বরূপ গত ২ মে মালয়েশিতে ‘জো জো ইন্টারন্যাশনাল আইকোনিক স্টার অ্যাওয়ার্ড’ পদকে ভূষিত হয়েছেন হাবিবুর রহমান। ঠার ভাষাগ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে ও বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্প্রতি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ‘এপিজে আবদুল কালাম ইন্টারন্যাশনাল আওয়ার্ডে’ ভূষিত হয়েছেন তিনি, যেটি তার ব্যক্তি জীবন, কর্ম জীবন ও দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের।
নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাওয়া এই প্রচারবিমুখ হাবিবুর রহমান ডিএমপির কমিশনারের পদ অলংকৃত করেছেন। এটি ডিএমপি তথা বাংলাদেশ পুলিশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, তিনি ডিএমপির কমিশনার হওয়ায় রাজধানীবাসী যে পুলিশি সেবার বিষয়ে অধিকতর আস্থাশীল এবং সমাজের অচ্ছুত ও প্রান্তবর্তী মানুষের মনের আশার আলো যে আরও উজ্জল হবে, সেটিই বড় সুখের কথা।