মানিকগঞ্জ-১ আসন থেকে পরপর দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হিসেবে ক্লিন ইমেজের দুর্জয়ের ওপর ভরসা রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ক্ষমতার স্বাদ পেতেই বদলে যায় তার চরিত্র। জমি দখল, রাতারাতি পাওয়ার প্ল্যান্টের মালিক বনে যাওয়া, এলাকায় মাদক ব্যবসার মদদ দেওয়া থেকে শুরু করে অর্থপাচার করে মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমও বানিয়েছেন তিনি।
সেই দুর্জয়ের বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চুপ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির সূত্র বলছে, তার বিরুদ্ধে এখনও কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পরপরই দখলবাজ হয়ে ওঠেন। তার বাহিনী একের পর এক খাস জমি দখলে নিতে শুরু করে। এছাড়া মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন উৎস থেকে তিনি অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেন। এমপি হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই তিনি বনে যান পাওয়ার প্লান্টের পরিচালক।
শুধু তাই নয়, দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এমপি হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যেই তার সম্পদ বেড়েছে আট গুণ।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সময় তিনি বছরে আয় দেখিয়েছেন ৪৩ লাখ ৭৫ হাজার ২শ টাকা। এক্ষেত্রে কৃষিখাত থেকে বছরে ৫২ হাজার ৮শ টাকা, পারিতোষিক ও ভাতাদি থেকে আয় ২৩ লাখ ৪২ হাজার ৪শ টাকা এবং মৎস্য চাষ থেকে আয় দেখিয়েছেন ১৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
এর পাঁচ বছর আগে দশম সংসদ নির্বাচনের সময় তিনি বছরে আয় দেখিয়েছিলেন ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। যেখানে কৃষিখাতে ১ লাখ টাকা এবং ব্যবসা থেকে ৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা আয় ছিল তার।
অর্থাৎ প্রথমবার এমপি হওয়ার পর পাঁচ বছরের মধ্যেই তার বাৎসরিক আয় বাড়ে ৭ দশমিক ৬৮ গুণ।
এমপিপত্নী ফারহানা রহমান হ্যাপিও স্বামীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে দখলবাজি শুরু করেন। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন সড়ক ও জনপথের বহু দামি জায়গা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মূলজান এলাকায় এই জমিতেই হ্যাপির নামে দুর্জয় পরিবারের শপিং মল তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা যায়।
এছাড়া কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে বিক্রি করারও অভিযোগ আছে হ্যাপির বিরুদ্ধে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মেগা ফিড কারখানার পেছনে অন্তত তিনটি স্পটে ফসলি জমি দখল করে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। সেই মাটি আনা-নেওয়ার কাজে ট্রাক চালিয়ে ক্ষতি করা হচ্ছে আশেপাশের ফসলি জমির।
স্ত্রীর নামে এত সম্পত্তি থাকলেও নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় স্ত্রী ফারহানা রহমান হ্যাপির নামে যথাযথ কোনো আয়ের উৎস দেখাতে পারেননি দুর্জয়।
অভিযোগ আছে, অবৈধভাবে অর্জিত এই সম্পদ বিদেশে পাচার করে এ দম্পতি মালয়েশিয়ায় গড়েছেন ‘সেকেন্ড হোম’।
এমনকি যুব মহিলা লীগের বিতর্কিত নেত্রী শামিমা নূর পাপিয়ার সঙ্গেও ‘হট কানেকশন’ ছিলো দুর্জয়ের। পাপিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর তার কাছ সুবিধাভোগীদের যে তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেখানে উঠে আসে দুর্জয়ের নাম।
সম্পদের বিষয়ে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেখবে’ বলে জানান সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়। অন্যদিকে তার নাম ব্যবহার করে কেউ যদি অন্যায় কাজ করে তাহলে তাদের নাম পরিচয় জানতে চেয়েছেন তিনি। অভিযোগ পেলে নিজেই ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার দাবি করেন।
দুর্জয় বলেন, আয়ের উৎস তো এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) দেখবে। এনবিআর দেখুক আয়ের উৎস, আয়ের টাকা কই গেল?
আর মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগের সূত্র সম্পর্কে জানতে চান।
এত সম্পদ আর দুর্নীতির অভিযোগ যার নামে সেই নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই দুর্নীতি দমন কমিশনে। কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দায়িত্ব নেওয়ার পর দুদক অনেক রাঘল-বোয়ালের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ক্যাসিনোকাণ্ডে দুদকের ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিতও হয়েছে। কিন্তু দুর্জয়ের বিষয়ে অজানা কারণে নিশ্চুপ হয়ে আছে দেশের দুর্নীতি দমনের সর্বোচ্চ সংস্থাটি।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত বলেন, নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে দুদকে কোনো মামলা নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার বিষয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, সেগুলো কমিশন গোপনে যাচাইবাছাই করবে। অনুসন্ধানযোগ্য হলে দুদক অবশ্যই অনুসন্ধান করবে।