মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি :
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলায় এক দম্পতির মধ্যে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করে দেওয়ার জন্য থানায় ডেকে হামিদুর রহমান (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে মারধর করে আহত করার অভিযোগ উঠেছে। পরে মঙ্গলবার রাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত হামিদুরের মৃত্যু হয়।
গত রোববার বিকেলে পত্নীতলা থানায় হামিদুরকে মারধরের ঘটনা ঘটে। তবে হামিদুরকে মারধরের কথা অস্বীকার করেছে পুলিশ। হামিদুর পত্নীতলা সদর ইউনিয়নের কাটাবাড়ী বোরাম গ্রামের বাসিন্দা। বুধবার হামিদুরের লাশের ময়নাতদন্ত নওগাঁ সদর হাসপাতালে সম্পন্ন হয়েছে।
পরে বিকেলে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। হামিদুরের স্বজনদের অভিযোগ, কাটাবাড়ী বোরাম গ্রামের বাসিন্দা হামিদুর ও তার স্ত্রী ফাইমা খাতুনের প্রায় ৩০ বছরের সংসার। ১৫-১৬ দিন আগে পারিবারিক বিষয় নিয়ে মনোমালিন্যের জেরে হামিদুর তার স্ত্রীকে মৌখিকভাবে তালাক দেন।
এ ঘটনার পর হামিদুরের দুই ছেলে মায়ের পক্ষ নিয়ে তাকে মারধর করেন। বিষয়টি নিয়ে হামিদুর তার ছেলেদের বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করলে ১৭ এপ্রিল সমঝোতার কথা বলে পুলিশ উভয় পক্ষকে থানায় ডাকে। সেই সমঝোতা বৈঠকে হামিদুর তার স্ত্রীকে মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ওই ঘটনার পর গত রোববার ফাইমা থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হামিদুর তাকে স্ত্রী হিসেবে এখনো মেনে নেননি। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে ওই দিন উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল ইসলাম সমঝোতার কথা বলে হামিদুরকে তার বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যান।
সেদিন থানায় হামিদুর-ফাইমা দম্পতি ছাড়াও তাদের অভিভাবক ও স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন। সমঝোতা বৈঠকে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে হামিদুরকে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামসুল আলম শাহ লাথি ও ঘুষি মারতে শুরু করেন। এ সময় দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাথায় গুরুতর আঘাত পান হামিদুর।
একপর্যায়ে হামিদুরকে থানা হাজতে বন্দী করে রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ওই ঘটনার পর মাথায় ও বুকে আঘাত পাওয়া হামিদুর বাড়ি থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রক্তবমি করা শুরু করলে হামিদুরকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।
সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পরও হামিদুরের অবস্থার উন্নতি না হলে রাত ১১টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পত্নীতলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ খালেদ বলেন, মঙ্গলবার রাত আটটার দিকে যখন হামিদুরকে হাসপাতালে আনা হয়, তখন তিনি রক্তবমি করছিলেন।
এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে রাজশাহীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। ঠিক কী কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে, এটা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই বলা যাবে। হামিদুরের মা আছিয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, ‘হামিদুরের স্ত্রী ও ছেলেদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে থানায় ডেকে নিয়ে পুলিশ তাকে মারধর করে।
পুলিশের মারধরেই আমার ছেলের মৃত্যু হয়েছে। আমি এ হত্যার বিচার চাই। আছিয়া বেগম আরও বলেন, ২৫ এপ্রিল থানায় পুলিশের মারধরে হামিদুর বুকে ও মাথায় প্রচ- আঘাত পান। সেদিন বাড়িতে আসার পর তিনি বুক ও মাথার ব্যথার জন্য স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে ওষুধ খাচ্ছিলেন।
মঙ্গলবার বিকেল থেকে তিনি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে রক্ত বমি করা শুরু করলে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে রাজশাহী মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গত রোববার থানা চত্বরে হামিদুরকে মারধরের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তার (হামিদুর) খালাতো ভাই ফারুক হোসেন বলেন
গত রোববার থানায় তুলে আনার পর থানার ওসি শামসুল আলম ও এসআই আশরাফুল হামিদুরকে তার স্ত্রীকে মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু হামিদুর কিছুতেই তার স্ত্রীকে আর ঘরে তুলবেন না বলে তাদের জানান। হামিদুর বলেন, ওই স্ত্রীকে তিনি আর ঘরে নেবেন না।
প্রয়োজনে যত দেনা-পাওনা সব পরিশোধ করবেন। এ কথা বলার পর ওসি শামসুল ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে হামিদুরকে লাথি মারেন। পরে হামিদুরের বুকে ঘুষি মারলে দেয়ালের সঙ্গে তার মাথার ধাক্কা লাগে। মারার পর থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুলিশের মারপিটের কারণেই অসুস্থ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।
ফারুক আরও বলেন, ‘হামিদুরের মৃত্যুর ঘটনায় থানায় মামলা করতে এলে পুলিশ মামলা নিতে চাইছে না। থানায় মামলা না নিলে আমরা এ ঘটনায় আদালতে মামলা করব। অভিযোগের বিষয়ে পতœীতলা থানার ওসি শামসুল আলম দাবি করেন সমঝোতার জন্য হামিদুরকে থানায় ডেকে নেওয়া হয়েছিল এ কথা ঠিক।
কিন্তু তাকে থানায় কোনো মারধর করা হয়নি। থানায় মারধরের ফলে আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাকে এখান থেকেই হাসপাতালে নেওয়া হতো। ঘটনার তিন দিন পর অসুস্থতার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
এরপরও এ ঘটনায় একটা অভিযোগ ওঠায় ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশে এ ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে এবং নওগাঁ সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে তার লাশ স্বজনদের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে পতœীতলা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফতাব উদ্দিন বলেন, মৃত্যু নিয়ে একটা অভিযোগ ওঠায় বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। স্বজনদের সামনেই হামিদুরের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করা হয়েছে। লাশের শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
নওগাঁ সদর হাসপাতালে হামিদুরের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। আফতাব উদ্দিন আরও বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে থানা-পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তার ভিত্তি পাওয়া যায়নি। অন্য কোনো রোগের কারণে হামিদুরের স্বাভাবিক মৃত্যুও হতে পারে।