ওয়াকিল আহমেদ নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট যদি আমরা বিচার-বিশ্নেষণ করতে যাই তবে শুরু করতে হবে ১৯৭১ সাল থেকে। কারণ ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রটির সৃষ্টি ও জন্মকালীন প্রেক্ষাপট যদি না বুঝতে পারি তবে বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ গতিপথ বোঝা দুস্কর হয়ে দাঁড়াবে। ঠিক যেমনি শিকড়কে না চিনলে গাছ থেকে কী রকমের ফল আসবে তা বোঝা দায়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহ্বান এবং পরবর্তীকালে প্রবাসী সরকারের অধীনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে কতোগুলো বিষয়ের উল্লেখ আছে। তার মধ্যে প্রধানতম বিষয় হলো জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পাকিস্তানি হানাদার গোষ্ঠীর নজিরবিহীন পৈশাচিক জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিগতভাবে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি। পাকিস্তানের গণহত্যার বিরুদ্ধে এ জাতি সেদিন এক হয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গণযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় অর্জন করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয় সেই সংবিধানের মূলনীতি হলো জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই সংবিধানকে, বিজয় অর্জন করার মাত্র ১১ মাসের মধ্যে প্রস্তুত করে প্রথম বিজয় দিবসে বলবৎ করা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমাদের মনে রাখা দরকার, এই সংবিধান কারও দয়ার দান নয়, এই মাটির দাবি পূরণে অন্যায় ও গণহত্যার বিরুদ্ধে জনগণের শাসন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ দুটি অমূল্য দলিল জাতি হিসেবে জন্মের সময়ে আমাদের সামগ্রিক অর্জন। এই ভূ-খণ্ডের মানুষের আজকের মূল সমস্যা হিসেবে আমি আইনের শাসনের অনুপস্থিতিকেই চিহ্নিত করি। আইনের শাসন এক দিনে অর্জন করা সম্ভব নয়, এটা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কেবল অর্জিত হতে পারে। আমরা আইনের শাসনের প্রসঙ্গে, কথায় কথায় ভারতবর্ষ, ইংল্যান্ডের কথা বলি। আজকে যদি ভারতের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস আর ইংল্যান্ডের কথা যদি বলি তবে ইতিহাস পর্যালোচনার ভিত্তিতে বলবো ওদের গণতন্ত্রের ইতিহাস কিন্তু এক-দুই দিনের না, কয়েক শতাব্দীর। আমাদের দেশে ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত জারি ছিল ব্রিটিশ বেসামরিক বাণিজ্যভিত্তিক উপনিবেশবাদ আর পাকিস্তানের আমলে ছিল সামরিক উপনিবেশবাদের সিনসিলা। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম কয়েকটি বছর বাদে ‘৯০-এর দশক পর্যন্ত সামরিক জান্তার অধীনেই ছিলাম, গণতন্ত্রবিহীন ছিলাম আমরা। সেই হিসেবে ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কেবল স্বাধীনতার প্রথম ৩ বছর বাদে টানা সামরিক জান্তার পদতলে সরাসরি পিষ্ট অবস্থায়ই আমাদের থাকতে হয়েছে। ‘৯০-এর পর থেকে বলা যেতে পারে আমরা গণতন্ত্রের পথে হাঁটি হাঁটি পা পা করে চলেছি। আইনের শাসনের বেলায় এখানে কিছু ব্যত্যয় উল্লেখ করতেই হয়। আমি যদি দণ্ডবিধির কথাই বলি, এটা হয়েছিল ১৮৬০ সালে। ১৮৫৭তে কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহ হয়, সেই বিদ্রোহ দমনের প্রেক্ষাপটে আইন-আদালতকে অস্ত্র হিসেবে অপব্যবহারের উদ্দেশ্যেই রচিত হয় দণ্ডবিধি। সেই দণ্ডবিধিটিই এখনও পর্যন্ত প্রচলিত আছে। সেই দণ্ডবিধির মূল উদ্দেশ্য ছিল শাসন এবং শোষণ বজায় রাখা এবং সেই একই ধারাবাহিকতা পাকিস্তানিরাও বজায় রেখেছে। ১৮৯৮ সালে ফৌজদারি কার্যবিধি আসে, সেটিরও উদ্দেশ্য ছিল আদালতে প্রক্রিয়াগত আইনের প্রয়োগ করে, শাসনের নামে শোষণ জারি রাখা। দুর্ভাগ্য ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এটিও এখনও বহাল আছে। আজকে সারা পৃথিবীতে যদি আপনি তাকিয়ে দেখেন তবে দেখবেন পুরো পৃথিবীটাই একটা অন্ধকার যুগে প্রবেশ করেছে এবং চরম ক্রান্তিকাল পার করছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর জায়গায় নরেন্দ্র মোদি, শ্রীলঙ্কাতে শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের স্থলাভিষিক্ত বর্তমান রাজাপাকসে, মিসরে কর্নেল জামাল আবদেল নাসেরের জায়গায় জেনারেল সিসি, চীনে মাও সে তুং-য়ের জায়গায় শি জিনপিং, লেনিনের দেশে পুতিন, আব্রাহাম লিঙ্কনের দেশে কিছুদিন আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেখেছি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। সারা পৃথিবীতে উদারপন্থি মানবিক নেতৃত্বের সর্বশেষ নজির হিসেবে ফিদেল কাস্ত্রো, নেলসন ম্যান্ডেলার নাম নিতে পারি। আমার মনে হয় বর্তমান বিশ্ব চরম নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে, কারণ যেই অর্থে ম্যান্ডেলাকে সর্বজনীন নেতা হিসেবে আমরা দেখি, সেভাবে আপনি সর্বজনীন নেতৃত্ব কিন্তু খুঁজে পাবেন না। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বই নয়; সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া- সমস্ত ক্ষেত্রেই একরকম শূন্যতা বা ভ্যাকম বিরাজ করছে, কাজের মান, মানুষের নৈতিকতার মান আগের চাইতে অনেক নিচে নেমে গেছে। বিশ্বব্যাপীই মানবসভ্যতা যেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের সংকট ও সততা-মেধাহীনতার গ্যাঁড়াকলে পড়েছে। পৃথিবীখ্যাত ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মাদার’, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’- এ ধরনের বই আজকে নেই; ‘দ্যা বার্ডস’, ‘পথের পাঁচালী’, ‘অপুর সংসার’-এর মতো ছায়াছবিও আজকাল দেখা যায় না। শুধু ভারতবর্ষই নয়, পৃথিবীব্যাপী একটা অবক্ষয় লক্ষণীয়। বিশ্বব্যাপী এই অবক্ষয়ের মধ্যেই বাংলাদেশে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আর সংবিধান রক্ষার শপথই জানান দেয় যে এই বৈশ্বিক অবক্ষয় আমরা মানছি না। আন্তর্জাতিকতার নামে অপসংস্কৃতিকে যেমনি ঠাঁই দেওয়া চলবে না, তেমনি নিজ সত্তাও বিকিয়ে দেওয়া যাবে না; বিশ্বায়নের এই যুগে অপসংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করে নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে উন্নত সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। ভাষার ক্ষেত্রে যদি বলি তবে বলব বহু ভাষা শিক্ষা যেমন দরকার, ঠিক তেমনই দরকার নিজ ভাষা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ার মানসিকতা। আরেকটি বিষয় হলো জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মাভিমান আছে, এটা থাকা ভালো। আমাদের আত্মমর্যাদাবোধের সাক্ষী হচ্ছে একাত্তর, নব্বই। এটা অবশ্যই থাকা উচিত। পৃথিবীর বুকে তখনই আমরা আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব, যখন আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, বঙ্গবন্ধুর শেষ জীবনের স্বপ্নও কিন্তু এটাই ছিল। তিনি সরকারি কর্মচারীদেরই শুধু স্মরণ করিয়ে দেননি, নিজে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞচিত্তে নিজ দায়িত্ববোধের কথাও স্মরণ করেছেন অকপটে। তিনি বারবার মানুষে মানুষে শোষণ বন্ধের কথা বলেছিলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির কথা বলেছিলেন। অর্থনৈতিক মুক্তি মানে ধনিক শ্রেণির উত্থান নয়। অর্থনৈতিক মুক্তি হলো মানুষে মানুষে শোষণ, শ্রেণিতে শ্রেণিতে শোষণ, শ্রেণি বিদ্যমান সমাজের অবলুপ্তি। তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা আমাদের দায়িত্ব। নতুন প্রজন্মকে এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে নিজ দেশাত্মবোধ থেকে। এই খানে আমি কয়েকটি কথা বলব। আমাদের প্রশাসককে মৌখিকভাবেই শুধু নয়, সংবিধানের মূল্যবোধকে অন্তরে ধারণ করতে হবে এবং সেই অনুযায়ীই প্রশাসনের সকল কাজ করতে হবে। এখানে সকল ধর্মের, সকল মানুষের সমানাধিকার আছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিও মুখেই শুধু সম্মান দেখালে চলবে না। নিজেকে প্রভু ভেবে জনগণকে দাস মনে করার মনোবৃত্তি শহীদের প্রতি ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি সবচাইতে বড় অপমান, অবজ্ঞা ও বেয়াদবি। বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন রেখেছিলেন, যারা চাকরিজীবী তারা কিসের সাহেব। তিনি নিজে জনগণ, কৃষক-শ্রমিকের রক্ত-ঘামের পয়সায় সাহেব হওয়ার কথা বলেছেন। তো আমি মনে করি সেই সাহেবের আজকে মনে রাখতে হবে তারা এই দেশের শাসনকর্তা না, তারা এই দেশের সেবক। পুলিশ, প্রশাসন শাসনকর্তা না, তারা সকলেই সেবক। পুলিশের দায়িত্ব হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করা, সুশৃঙ্খলভাবে যাতে দেশ চলতে পারে সেদিকে খেয়াল দেওয়া; আর প্রশাসনের দায়িত্ব হলো জনগণের সব ধরনের কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। আমাদের প্রশাসনের সংবিধানের প্রতি আস্থাশীল হতে হবে, সংবিধানকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। নিজে জনগণের পয়সায় চলে জনগণের ক্ষমতাকে খর্ব করা যাবে না। সেই দিক থেকে আমি বলবো প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাইকে সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সবচাইতে বড় বিষয় হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কাছে যাতে আমরা নতি স্বীকার না করি সেটা নিশ্চিত করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতির মানেই হলো একটা অসভ্য জাতিতে পরিণত হওয়া, আমরা কিছুতেই এটা হতে দিতে পারি না। আমরা যেকোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে বিচার অঙ্গনের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখব। চরম অপরাধীর ক্ষেত্রেও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নিজ হাতে আইন তুলে নেবো না, বিচারের মাধ্যমে শাস্তির নিশ্চয়তা বিধানের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করব। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও যেন শাস্তি না পায় সেদিকে সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। এমনই আমাদের আইনের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হচ্ছে হাজারজন অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক, কিন্তু একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও যেন শাস্তি না পায়। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই দেশটাকে পরিচালিত করতে হবে। বাংলাদেশে নিরপরাধ ব্যক্তির শাস্তি হলে সেটা হবে সবচাইতে বড় জুলুম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের সরাসরি পরিপন্থি জঘন্যতম অপরাধ।