কামাল উদ্দিন, চকরিয়া-পেকুয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধিঃ:
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার ছোট্ট ইউনিয়ন ফাইতং। কক্সবাজারের চকরিয়ার বানিয়ারছড়া থেকে সিএনজিচালিত অটোরিক্সায় ওই এলাকায় ঢোকার সময় চারদিক ছিল ধুলায় ধূসর। ভাঙা রাস্তা ধরে ইট কিংবা কাঠবোঝাই বড় ট্রাক হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে। ধুলা উড়ছে। ফাইতং ইউনিয়নের কাছাকাছি পৌঁছাতেই দেখা যায় ধোঁয়া। এই ধোঁয়ার উৎস এলাকার ৩০টি ইটভাটা। সরকারি হিসাবে ৩০টি হলেও সাধারণের হিসাবে তা আরও বেশি। ছোট্ট একটি ইউনিয়নের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ৩০টি ইটভাটা দেশের আর কোথাও আছে কি না জানাতে পারেনি পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে এসব ভাটা বনাঞ্চল, পাহাড়, আবাসিক এলাকা সব দিক দিয়ে অবৈধ। ইটভাটার কারণে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। ফাইতং স্টেশন থেকে দুটি সড়ক দুদিকে পাহাড়ি পথে চলে গেছে। দুদিকেই দেখা যাবে ইটের চুল্লি। উত্তর দিকের পাহাড়ি পথ পেরিয়ে শিবাতলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটির শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২শ জন। তার পাশেই রয়েছে ইটভাটা। পাশে ইটভাটা একটি নয়, পাঁচটি। খুব কাছেই এবিসি ব্রিকস। ভাটাটিতে সিমেন্টের লম্বা চুল্লি। পাশাপাশি দুটি ইটভাটা ব্যবসায়ী মো. বেলালের। তার কাছাকাছি রয়েছে আরো ৩টি। পাশে পড়ে আছে বন থেকে কেটে আনা কাঠের স্তূপ। শিবাতলীপাড়া থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিম দিকে রোয়াজাপাড়া। ওখানে গিয়ে দেখা যায়, শুধু চুল্লি আর চুল্লি। এখানে প্রায় ১০টি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটার কাছে ঘেঁষেই আছে বসতি ও বনাঞ্চল। বনের কাঠ নিয়ে ভাটায় ঢুকছে ট্রাক। আর ইটভাটার মাটির জোগান দিতে গিয়ে পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা হচ্ছে। রোয়াজাপাড়া মৈত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেও রয়েছে ইটভাটা। এ ছাড়া হেডম্যান পাড়ায় তিনটি ও রাইম্যাখালীতে দুটি ইটভাটা দেখা গেছে। স্থানীয় দুই বাসিন্দা বললেন, ইটভাটার ধুলাবালি রাস্তা থেকে শুরু করে ঘর, স্কুল সব জায়গায়। এদিকে লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে ইটভাটাগুলোর কোনো ধরনের সরকারি ছাড়পত্র নেই তারপরও দিব্যি বনের কাঠ পুড়িয়ে পাহাড় ধ্বংস করে চলছে। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী কোনো পাহাড় বা টিলার উপরিভাগে, ঢালে বা তৎসংলগ্ন আধা কিলোমিটারের মধ্যে সমতলে ইটভাটা স্থাপন অবৈধ। এ ছাড়া আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে এবং বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এদিকে, লামা উপজেলার ৩০৬নং ফাইতং বাঙ্গালীপাড়া এলাকার খিজিরিয়া ব্রিকস কোম্পানি নামের এক ইটভাটার মালিকের অনুপস্থিতিতে ঐ ইটভাটার ম্যানেজারের কাছে পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করেই আমরা পাহাড় থেকে মাটি নিচ্ছি। প্রায় দশ লক্ষ টাকা পরিবেশ অধিদপ্তরকে দিতে হয়েছে। এর বাহিরেও বিভিন্ন প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা ইটভাটা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক শ্রীরুপ মজুমদার বলেন, ফাইতংয়ে ৩০টির মতো ইটভাটা রয়েছে। সব কটিই অবৈধ। গত দুইমাস আগে ফাইতংয়ের সবকটি ব্রিকফিল্ডকে ১ কোটি ৮ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। তারপরও বন্ধ হয়নি। বান্দরবান জেলায় যে ইটভাটাগুলো আছে তাতে অভিযান পরিচালনা করার জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। ইটভাটার কারণে পাহাড় কাটা এবং বনাঞ্চল থেকে গাছ কেটে ইটভাটার জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহারের বিষয়ে অতিশীঘ্রই আমরা অভিযান পরিচালনা করবো এবং তা অব্যাহত থাকবে। পাহাড়ের আধা কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষেধ। কিন্তু ফাইতংয়ের ইটভাটাগুলোর বেশির ভাগ পাহাড়ের ওপর করা হয়েছে। কাঠ পোড়ানো নিষেধ। কিন্তু এগুলোতে বনের কাঠ পোড়ানো হয়। এসব ভাটার পরিবেশ ছাড়পত্র বা জেলা প্রশাসনের ছাড়পত্র কোনোটি নেই। ইটভাটাগুলোর মালিকেরা বেশির ভাগ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক পরিচয় তেমন নেই। তাঁরা পাশের উপজেলা চকরিয়া ও অন্যান্য এলাকার বাসিন্দা। ফাইতং ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতি নামে একটি সংগঠনও গড়ে তুলেছেন তাঁরা। সমিতির সভাপতি মোকতার আহমদ সাবেক ইউপি সদস্য। সমিতির অধীনে ৩০টি ইটভাটার মধ্যে ২৯টি চালু রয়েছে।