রোস্তম আলী: রংপুর জেলা প্রতিনিধি
নকল ও জাল ব্যান্ডরোল দিয়ে বিভিন্ন নামে বিড়ি তৈরি করে রংপুরাঞ্চলসহ পার্শ্ববর্তী হাট-বাজারগুলোতে বাজারজাত করে আসছে এক শ্রেণির অসাধু বিড়ি ব্যবসায়ীরা। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অভিযানের মধ্যেও মহামারী করোনাকালীন সময়কে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে এবং দোকানদারদের উপঢৌকন দিয়ে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে এসব অবৈধ্য বিড়ি। এতে করে প্রতি মাসে শুধুমাত্র হারাগাছ এলাকা থেকে প্রায় ৯০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে এসব কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন কাস্টমস বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তারা এই অবৈধ কারবারে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। যোগসাজস থাকায় নকল, জাল ও ব্যান্ডরোল বিহীন বিড়ির কারখানাও বিক্রি বন্ধে দৃশ্যমান কোন অভিযান চোখে পড়ে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যান্ডরোলবিহীন, নকল ও জাল বিভিন্ন নামে বিড়ি তৈরি বাজারজাতকরণে কোন আইন ও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না অবৈধ বিড়ি তৈরির মালিকরা। অধিক মুনাফা ও ব্যান্ডরোলবিহীন বিড়ি বাজারজাতের জন্য যেমন ডালা, ক্যাবিনেট, বিভিন্ন ধরনের প্যাকেট ডিসপ্লে, কুপন, নগদ টাকা, লুঙ্গি, গামছাসহ বিভিন্ন লোভনীয় জিনিসপত্র দোকানদেরকে দেয়া হচ্ছে। একারণে দোকানদাররাও নিম্নমানের বিড়ি ধূমপান করার কারণে ভোক্তারাও অধিকতর ঝুঁকিতে পড়ছেন। মাঠপর্যায়ের কিছু অসাধু রাজস্ব কর্মকর্তা নকল ব্যান্ডরোল কারবারীকে উৎসাহিত করে চলেছেন। বিশেষ করে যাচাই-বাছাই ছাড়া অনলাইনে বিড়ি ফ্যাক্টরির লাইসেন্স দেওয়ায় তারা সরকারি ব্যান্ডরোল ক্রয় না করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ভুয়া ব্যান্ডরোল দিয়ে বিড়ি-সিগারেট বাজারজাত করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছেন। এসব কারণে সরকারও প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছেন।
রাজস্ব বোর্ডের আইন অনুযায়ী, প্রতিটি ২৫ শলাকার বিড়ির প্যাকেটের ব্যান্ডরোলে মূল্য, সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর, সারচার্জ ও স্বাস্থখাত মিলে এক প্যাকেট বিড়ি বাজারজাতকরণে মোট রাজস্ব খাতে ব্যয় হয় নয় টাকা দশ পয়সা। আর ২৫ শলাকা বিড়ি তৈরিতে মালিকদের ব্যয় হয় কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ টাকা। সে হিসাব অনুযায়ী ১ প্যাকেট বিড়ি বাজারজাতে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৬ টাকা। একারণে সরকারিভাবে বিড়ি বিক্রির জন্য প্রতি ২৫ শলাকার ১ প্যাকেট বিড়ির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিয়ম অনুসারে ১ প্যাকেট বিড়ির দাম ১৮ টাকার নিচে বিক্রি করা হলে সেসব বিড়িগুলো জাল ও অবৈধ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রংপুর বিভাগে প্রতিদিন বৈধ অবৈধ মিলে প্রায় ১ কোটি শলাকা বিড়ি বাজারজাত হয়। এর মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ বিড়ি সরকারি রাজস্ব মেনে বাজারজাত করা হয়। বাকী ৭০ ভাগ বিড়িই নকল, জাল ও ব্যান্ডরোলবিহীনভাবে বাজারজাত হয়ে আসছে। হিসাব অনুযায়ী, ৭০ ভাগ অর্থাৎ ৭০ লক্ষ শলাকা বিড়ি। একারণে সরকার প্রতি মাসে শুধুমাত্র হারাগাছ এলাকা থেকে প্রায় ৭৬ কোটি ৩৫ লাখ ০৬ হাজার টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। এই পরিসংখ্যানটি বৈধ বিড়ি ব্যবসায়ীদের হলেও সারাদেশের সার্বিক বিবেচনা আসলে রাজস্বের ক্ষতি আরও কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে। সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুরাঞ্চলের বাজারগুলোতে মাছুম বিড়ি, ভাই ভাই বিড়ি, যমুনা বিড়ি, ফ্রেশ বিড়ি, লাটিম বিড়ি, সেলিম বিড়ি, স্টার আকিজ বিড়ি, মোহন বিড়ি ও আসাদ বিড়িসহ নামে বেনামে কমপক্ষে প্রায় ৬০টিরও অধিক নকল, জাল ও ব্যান্ডরোলবিহীন বিড়ি ছোট বড় দোকানগুলোতে অবাধে পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিড়ি রংপুরের হারাগাছ ও তার আশপাশের পাড়াগুলোতে তৈরি করা হচ্ছে। এই অবৈধ বিড়িগুলো কাস্টম কর্মকর্তা, কর্মচারী ও স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করে তাঁদের নাকের ডগার উপর দিয়ে বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেলে করে বহন করে বাজারজাত করা হচ্ছে। তারা বিড়িগুলো ছোট বড় দোকানগুলোতে ২৫ শলাকার ১ প্যাকেটের দাম ৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৬ টাকায় বিক্রি করছে। আর দোকানদারা বিক্রি করছেন ৫ টাকা থেকে ৭ টাকায়। আবার বিড়ির প্যাকেটগুলো সহজেই বাজারজাত করতে অবৈধ ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত পুরুস্কার হিসেবে প্যাকেটের ভিতর ২ টাকাসহ অন্যান্য পুরুষ্কার দিচ্ছেন। এতে ছোট বড় দোকানদাররা অতি উৎসাহিত হয়ে ওই অবৈধ বিড়িগুলো বিক্রি করছেন। এই বিড়িগুলো নকল, জাল ও ব্যান্ডরোল বিহীন।
বাংলাদেশ বিড়ি মালিক সমিতির সহ-সভাপতি ও রংপুর জেলা সভাপতি মজিবর রহমান মুঠোফোনে জানান, নকল, জাল ও ব্যান্ডরোলবিহীন বিড়ি তৈরি বন্ধে আমাদের করনীয় কিছু নেই। আমরা কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে বরাবরই এবিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছি, তারা যেন অভিযান চালিয়ে এসব বিড়ি উৎপাদন বন্ধ করে দেন। রংপুর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট বিভাগীয় কমিশনার ড. শওকত আলী সাদী সাংবাদিকদের জানান, গত এক মাসে নকল ব্যান্ডরোল বাজারজাতকারীদের বিরুদ্ধে প্রায় ২০০ অভিযান পরিচালনা করে ২ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় করা হয়েছে। বর্তমানে যারা আইন অমান্য করছে ও রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়িতের বিষয়টি এড়িয়ে যান।