আনোয়ার হোসেন আন্নু বিশেষ প্রতিনিধিঃ
২০১১ সালের ১৭ জুলাই পবিত্র শবে বরাতের রাতে সাভারের আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলার চরে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার পর স্থানীয় মসজিদের মাইকে “ডাকাত” বলে ঘোষনা দেয় হত্যাকারীরা। ১৮ জুলাই সকালে সাভার মডেল থানা পুলিশ ৬ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে থানা ক্যাম্পাসে নিয়ে আসে। এরপর মামলা থেকে বাঁচতে ৬ জনের বিরদ্ধে করা হয় ডাকাতি মামলা।
প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই জানান, সে সময় ৬টি লাশের শরীর ছিল ভেঁজা ও বালু মাখা। যেন শরীর চিড়ে রক্ত বের হয়ে আসছে। শরীরে অসংখ্য পিটুনির দাগ, ইট দিয়ে থেতলে দেয়ার চিহৃ ও ধারালো অস্ত্রের আঘাত ছিল।
এ সময় বড়দেশী থেকে আসা কয়েকজন লোকের মধ্যে ছিলেন বালু ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক। তিনি তখনও বলছেন ছেলেগুলো ডাকাত ছিল। কিন্তু, এমন ফুটফুটে চেহারার ছেলেদের লাশ দেখে উৎসুক মানুষের চোখে ছিল জল। মনে ছিল কষ্ট। এ হত্যা যেন কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এমনটিই বলছিলেন সাভার থানার পাশের একটি হোটেলের মালিক মনির হোসেন।
অজ্ঞাত এসব কিশোরদের পরিচয় সনাক্তের আগেই বড়দেশী গ্রামের বালু ব্যবসায়ী আব্দুল মালেক সাভার মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আসামি করা হয় নিহত ৬ জনকে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন গণমাধ্যম কর্মী বলেন, সে সময় নিজেরা বাঁচতে পুলিশের সাথে পরামর্শ করেই আব্দুল মালেক অজ্ঞাত নিহত ৬ ছাত্রের বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা দায়ের করেন। সাক্ষাতকারে সে সময় মালেক জানিয়েছিলেন, এসব ছেলেরা নাকি নেশা করতে কেবলার চরে নদীর পাশে এসেছিল। তাহলে নির্জন চরে নদীর তীরে তারা ডাকাত হলো কিভাবে তার উত্তর দিতে পারেনি মালেক। তবে তিনি জানান, মসজিদের মাইকে “ডাকাত” বলে ঘোষনা দেয়ার পরে শত শত লোক চরে চলে আসে। সবাই অংশ নেয় গণপিটুনি দিয়ে হত্যার উৎসবে।
পরে খবরটি গণমাধ্যমে প্রচারের পর দুপুরের দিকে ৬ ছাত্রের পরিচয় সনাক্ত হয়। পাল্টেযায় দৃশ্যপট।
জানা যায়, সাত বন্ধু বেড়াতে এসেছিল আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের কেবলার চরের নদী তীরে। রাত সোয়া একটার দিকে স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী ও দুর্বৃত্তরা তাদের নদী পার হয়ে এপারে আসার অপরাধে পিটিয়ে হত্যা করে। এরপর লাশগুলো চরে ফেলে রাখে। এ সময় আল-আমিন নামে এক ছাত্র পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।
নিহতরা হলেন ধানমণ্ডির ম্যাপললিফ স্কুলের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র শামস রহিম শাম্মাম, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইব্রাহিম খলিল, বাঙলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুর রহমান পলাশ, তেজগাঁও কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র টিপু সুলতান, মিরপুরের বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সিতাব জাবীর মুনিব এবং বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র কামরুজ্জামান।আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার মোট আসামি ছিল ৬০ জন। তাঁদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন, পলাতক ১২ জন। রায় ঘোষণা উপলক্ষে কারাগারে থাকা ৪৫ আসামিকে আজ আদালতে হাজির করা হয়।
এ মামলায় ২০১৩ সালের ৮ জুলাই ৬০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে ৫৫ জন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় গত বছরের ১৮ আগস্ট এবং যুক্তিতর্ক শুরু হয় চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি।
সচেতন মহলের দাবি, হামলায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ লোকই মাদক ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। আমিনবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ভয়ংকর গাংচিল বাহিনীর সদস্য ও পৃষ্টপোষক।
সাভার থানা সূত্রে প্রকাশ, ছয় ছাত্রকে হত্যার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে সাভার থানায় একটি মামলা করে। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলাটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি র্যাব ৬০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয়। এতে সাক্ষী করা হয় ৯২ জনকে। অভিযোগপত্রে বলা হয়, নিরীহ ছাত্রদের হত্যার উদ্দেশ্যে আসামিরা মারধর করেন। হত্যার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে স্থানীয় মসজিদের মাইকে ডাকাত আসার ঘোষণা দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইসমত জাহান রায় ঘোষণা করেন যে, মোট ৫৭ জন আসামির মধ্যে ৩২ জনকে মৃত্যু ও কারাদণ্ড দিলেন আদালত। বাকি ২৫ জন আসামি খালাস পেয়েছে।
মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে সাভারের আমিন বাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেনের নাম রয়েছে।
যে ১৩ জনকে মৃত্যুদন্ডের রায় দেয়া হয়েছে তারা হলেন, আব্দুল মালেক, সাঈদ মেম্বার, আব্দুর রশিদ, ইসমাইল হোসেন রেপু, জমছের আলী, মীর হোসেন, মজিবুর রহমান, আনোয়ার হোসেন, রজ্জব আলী, আলম, মোহাম্মদ রানা, আব্দুল হানিফ, আসলাম মিয়া।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- শাহিন আহমেদ, ফরিদ খান, রাজিব হোসেন, ওয়াসিম, সাফফার, সেলিম, মনির, আলমগীর, মোবারক হোসেন, অখিল খন্দকার, বসির, রুবেল, নুর ইসলাম, শাহাদাত হোসেন, টুটুল, মাসুদ, মোখলেস, তোটুল ও সাইফুল।
গত ২২ নভেম্বর ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ইসমত জাহান রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ২ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। মামলায় ৯২ সাক্ষীর মধ্যে ৫৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে এ রায় দেওয়া হলো।