মানসিক চিকিৎসার নামে রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতালে চলে ১৫ মিনিটের ‘ভয়ংকর অবজারভেশন’। সেই অবজারভেশন কক্ষেই চলে নির্মমতা। আর তাতেই নিথর বরিশাল মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপন। হাসপাতালকর্মীদের নির্যাতনেই যে পুলিশের এই কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে, তা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে উঠে এসেছে। এরই মধ্যে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার ১০ আসামিকে সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সঙ্গে আগামী ৯ ডিসেম্বর আদালতে এই ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা চিকিৎসার নামে নির্যাতনে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে এই নির্মম ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজটি ভাইরাল হলে দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। পুলিশ কর্মকর্তার এমন মৃত্যুতে স্বজন, সহকর্মী, সহপাঠীসহ সবার মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁরা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন।
এদিকে তদন্তে উঠে এসেছে, পিটিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যায় অভিযুক্ত মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতালটির মানসিক রোগী চিকিৎসার কোনো অনুমোদনই নেই। হাসপাতাল চালানোর মতো যে ধরনের বিশেষজ্ঞ মানসিক চিকিৎসক, কাউন্সেলর, জনবল, কাগজপত্র ও সুবিধা দরকার, এর কিছুই ছিল না। মাদকাসক্তি নিরাময়ের চিকিৎসার জন্য এক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স নিলেও শর্ত পালন করছিল না। গতকাল স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কর্মকর্তারা পরিদর্শন করে লাইসেন্স স্থগিত এবং বন্ধ করার সুপারিশ করেন। পরে পুলিশ হাসপাতালটি বন্ধ করে দিয়েছে। গত রাতে হাসপাতালটির পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদকেও গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এই হাসপাতালের মতোই সারা দেশে মাদকাসক্তি ও মানসিক চিকিৎসার নামে নৈরাজ্য ও নির্যাতনের চিকিৎসা চলছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের নেই লাইসেন্স। যারা লাইসেন্স নিয়েছে তারাও পরিচালনার শর্তগুলো মানছে না। মনগড়া চিকিৎসার নামে আটকে রেখে নির্যাতন এবং ঘুমের ওষুধ দিয়ে অচেতন করে রাখা হয় সেখানে। গত ১০ বছরে এসব প্রতিষ্ঠানে নির্যাতন ও অপচিকিৎসায় কমপক্ষে ৫০ জনের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, লাইসেন্সের আওতায় এনে এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
১৫ মিনিটের ভয়ংকর অবজারভেশন : আনিসুলের বাবা ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ মামলার এজাহারে বলেন, ‘তিন-চার দিন ধরে হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায় আনিসুল। পরিবারের সবার মতামত অনুযায়ী ছেলেকে চিকিৎসার জন্য গত সোমবার প্রথমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসি। পরে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য একই দিন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে যাই। আরিফ মাহমুদ জয়, রেদোয়ান সাব্বির ও ডা. নুসরাত ফারজানা আমার ছেলেকে ওই হাসপাতালে ভর্তির প্রক্রিয়া করতে থাকেন। ওই সময় আনিসুল হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে। হাসপাতালের নিচতলায় একটি কক্ষে বসে হালকা খাবার খায়। খাবার খাওয়ার পর আনিসুল ওয়াশরুমে যেতে চায়। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আরিফ মাহমুদ জয় ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে দোতলায় নিয়ে যান। তখন আনিসুলের বোন উম্মে সালমা তার সঙ্গে যেতে চাইলে জয় ও রেদোয়ান সাব্বির বাধা দেন এবং কলাপসিবল গেট আটকে দেন।’ ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ জানান, তিনিসহ তাঁর আরেক ছেলে রেজাউল করিম ও মেয়ে উম্মে সালমা নিচতলায় ভর্তিপ্রক্রিয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। তখন আনিসুলকে চিকিৎসার নামে দোতলার একটি অবজারভেশন কক্ষে নেওয়া হয়। কয়েকজন আনিসুলকে চিকিৎসা করার অজুহাতে সেই কক্ষে মারতে মারতে ঢোকান। কক্ষের ফ্লোরে জোর করে উপুড় করে ফেলে তিন-চারজন হাঁটু দিয়ে পিঠের ওপর চেপে বসেন, কয়েকজন আনিসুলকে পেছনমোড়া করে ওড়না দিয়ে দুই হাত বাঁধেন। একজন মাথার ওপরে চেপে বসেন এবং সবাই মিলে পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মেরে আঘাত করেন। এরপর দুপুর ১২টার দিকে আনিসুল নিস্তেজ হয়ে পড়েন। আরিফ মাহমুদ জয় নিচে এসে স্বজনদের ইশারায় ওপরে যেতে বললে স্বজনরা মেঝেতে নিথর আনিসুলকে পান। তখন তাঁরা একটি প্রাইভেট অ্যাম্বুল্যান্সে করে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ফাইজুদ্দিন আহম্মেদের অভিযোগ, অবৈধ উপায়ে টাকা উপার্জনের জন্য হাসপাতাল পরিচালনা এবং পরিকল্পিতভাবে তাঁর ছেলেকে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) হারুন অর রশীদ বলেন, এটি হাসপাতাল নয়, যেন জেলখানা। চিকিৎসার নামে মির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যার তথ্য পাওয়া গেছে। হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ হাসপাতালের সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের কেউ যদি জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালটির এক কর্মী বলেন, ওপরের অবজারভেশন কক্ষে নেওয়ার সময় জোরাজুরির একপর্যায়ে হাসপাতালটির মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়ের গায়ে ধাক্কা লাগে। তখন অন্য কর্মীরা বেপরোয়া হয়ে আনিসুলকে মারতে থাকেন। তাঁর ভাষ্য মতে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ভবনটি ভাড়া নিয়ে চালু করা হয় হাসপাতালটি। ছয়জনের মালিকানায় হাসপাতালটি চলছে বলে জানান ওই কর্মী।
মাইন্ড এইড হাসপাতালের বাবুর্চি শারমিন আক্তার বলেন, ‘এই হাসপাতালে যেসব রোগী আসতেন তাঁদের প্রথমত এই কক্ষে নিয়ে আসা হতো এবং যাঁরা বেশি উত্তেজিত হতেন তাঁদের এখানে এনে মারধর করা হতো। গতকালও (সোমবার) ওই রোগীকে (আনিসুল করিম শিপন) আমাদের অফিসের কয়েকজন ভাইয়া জোর করে ধরে নিয়ে আসেন এবং তাঁর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেন, একপর্যায়ে তিনি মারা যান।’
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সোমবার সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছে, উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় তারা পুলিশ কর্মকর্তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল।
১৫ জনের নামে মামলা, রিমান্ডে ১০ জন : এদিকে গতকাল আদাবর থানায় আনিসুলের বাবা ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ ১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। এর মধ্যে চার আসামি এখনো পলাতক। তাঁরা হলেন আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন ময়না। ওই মামলায় হাসপাতালটির মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন শেফ মাসুদ, ওয়ার্ড বয় জোবায়ের হোসেন, ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান, ওয়ার্ড বয় তানিম মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ ও সাইফুল ইসলাম পলাশকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাঁদের ঢাকা মহানগর হাকিম শহিদুল ইসলামের আদালতে তোলা হলে সবাইকে সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে আগামী ৯ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। রাতে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এডিসি মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, হাসপাতালটির পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদকে সন্ধ্যায় আগারগাঁওয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ পাহারায় তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন। এ নিয়ে মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
হাসপাতালটি অবৈধ : স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) ফরিদ উদ্দিন মিয়া বলেন, মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকশন হাসপাতালকে অবৈধ বলা যায়। এমন অনেক হাসপাতাল আছে, যারা আবেদন করেই চালু করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘সারা দেশে এমন হাসপাতালের ব্যাপারে আমাদের কাছে মাঝেমধ্যে অভিযোগ আসে। জেলাপর্যায়ে সিভিল সার্জন থেকে শুরু করে আমরা এটি তদারকি করি। তবে লোকবল সংকটের কারণে নজরদারি করা যাচ্ছে না। আমরা সব হাসপাতালকে লাইসেন্সের আওতায় এনে মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা করব। এটা চলমান প্রক্রিয়া।’ দুপুরে হাসপাতালটি পরিদর্শন করে ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মইনুল আহসান বলেন, ‘২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাইন্ড এইড হাসপাতাল চালানোর জন্য অনুমতি চাওয়া হয়েছিল। আমরা তখন পরীক্ষা করে দেখেছি, হাসপাতালটি চালানোর মতো সুবিধা ও জনবল কিছুই ছিল না। সে জন্য মার্চ মাসে তাদের আবেদন আমরা স্থগিত করি।’
মাদকাসক্তি চিকিৎসার শর্তও মানেনি : ডিএনসির ঢাকা মেট্রোর উপপরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ‘গত বছর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে আমরা লাইসেন্স দিই। ভবনটির তৃতীয় তলায় নিরাময় কেন্দ্র এবং দ্বিতীয় তলায় মানসিক চিকিৎসা চলছিল। ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় তলায়। প্রাথমিকভাবে যেভাবে নির্যাতনের আলামত আমরা পেয়েছি তা এককথায় অপচিকিৎসা। এ জন্য আমরা প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স স্থগিত করার সুপারিশ করেছি।’ তিনি আরো বলেন, ঢাকায় শতাধিকসহ সারা দেশে ৩৪০টি লাইসেন্সধারী নিরাময় কেন্দ্র আছে। অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স দিয়ে তাদের মান যাচাই করার প্রক্রিয়া চলছে।
কর্মস্থলে ও এলাকায় শোক : এদিকে বরিশালে আনিসুলের সহকর্মীরা বলছেন, কর্মরত অবস্থায় আনিসুলের কোনো অস্বাভাবিক আচরণ তাঁদের চোখে পড়েনি। আনিসুল একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী কর্মকর্তা ছিলেন। বরিশাল মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার জাকির আলম মজুমদার জানান, ৯ নভেম্বর থেকে তিনি ১০ দিনের ছুটিতে যাওয়ার আগের দিন গত রবিবারও নিজ কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন করেছেন। ৩১তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকারী এই কর্মকর্তা খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও র্যাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বরিশাল মেট্রোপলিটনে যোগ দেওয়ার আগে বরিশাল জেলা পুলিশের মুলাদী সার্কেলের দায়িত্বেও ছিলেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় গাজীপুর নগরীর ভাওয়াল রাজবাড়ী মাঠে তাঁর জানাজা শেষে গাজীপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। জানাজায় পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিপুলসংখ্যক লোক শরিক হয়। আনিসুল হত্যার ঘটনার বিচারের দাবিতে গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানববন্ধন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার সম্মানিয়া ইউনিয়নের আড়াল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহমেদের চার ছেলে-মেয়ের মধ্যে আনিসুল করিম ছিলেন সবার ছোট। প্রায় ৪০ বছর ধরে তাঁদের পরিবার গাজীপুর শহরের বরুদা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। আনিসুল ২০১১ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শারমিন সুলতানা। এ দম্পতির চার বছর বয়সী সাফরান নামে একটি ছেলে রয়েছে।