“সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও ডিগ্রী বাধ্যতামূলক করার প্রভাব”

লেখা: হাসান আলী

সাম্প্রতিককালে প্রেস কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত যে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ডিগ্রী বাধ্যতামূলক হবে, তা সাংবাদিকতা পেশায় একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে সাংবাদিকতা পেশায় এক ধরণের পরিবর্তনের সূচনা হতে চলেছে, যা ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই ফেলবে। এই সম্পাদকীয়তে আমরা এই পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করব।

পেশাদারিত্ব ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা:

সাংবাদিকতায় ডিগ্রী বাধ্যতামূলক করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল পেশার পেশাদারিত্ব বাড়ানো। আধুনিক সাংবাদিকতায় সঠিক তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিগ্রী প্রাপ্ত সাংবাদিকরা এই দক্ষতাগুলো আরও উন্নত করতে পারেন এবং সঠিক ও নির্ভুল তথ্য পরিবেশন করতে সক্ষম হন। একাডেমিক শিক্ষা সাংবাদিকদেরকে তথ্য যাচাই, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি, এবং সংবাদ লেখার বিভিন্ন কৌশল শেখায়, যা তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে

চাকরির বাজারের পরিবর্তন:

এই সিদ্ধান্তের ফলে সাংবাদিকতার চাকরির বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে। অনেক প্রবীণ সাংবাদিক যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কিন্তু ডিগ্রী নেই, তারা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। এছাড়াও, নতুন প্রজন্মের অনেক তরুণ সাংবাদিক যারা আর্থিক সমস্যার কারণে ডিগ্রী অর্জন করতে পারছেন না, তারা এই পেশায় প্রবেশের সুযোগ হারাতে পারেন। ফলে, সাংবাদিকতার চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে যেতে পারে এবং যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিকের সংখ্যা কমে যেতে পারে। সাংবাদিকতার ডিগ্রী বাধ্যতামূলক করার ফলে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অনেক স্থানীয় ও গ্রামীণ সংবাদ মাধ্যম আছে যারা কম প্রশিক্ষিত বা ডিগ্রী বিহীন সাংবাদিকদের উপর নির্ভরশীল। নতুন নিয়ম চালু হলে এসব সংবাদ মাধ্যমগুলো তাদের কর্মী সংখ্যা কমাতে বাধ্য হতে পারে, যার ফলে স্থানীয় সংবাদ পরিবেশন কমে যেতে পারে এবং স্থানীয় জনগণের তথ্য পাওয়ার সুযোগ হ্রাস পেতে পারে। এটি গণতন্ত্রের মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা হ্রাস করতে পারে।

প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার:

বর্তমান যুগে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ও উন্নয়ন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনছে। অনেক সংবাদ মাধ্যম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশন ব্যবহার করে সংবাদ তৈরি করছে। এই প্রেক্ষাপটে, সাংবাদিকতার ডিগ্রী বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা হয়তো ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, যা একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে ভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে

উপসংহার:

সাংবাদিকতায় ডিগ্রী বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তটি পেশার মান উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে, তবে এটি সাংবাদিকদের উপর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। চাকরির বাজারে চাপ, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা হ্রাস এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কারণে এই সিদ্ধান্তটি কতটা কার্যকর হবে তা সময়ই বলে দেবে। প্রেস কাউন্সিলের উচিত হবে এই পরিবর্তন বাস্তবায়নের সময় সাংবাদিকদের মতামত গ্রহণ করা এবং তাদের সহায়তা প্রদান করা, যাতে তারা এই পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন। এছাড়া, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বিত উদ্যোগ ও বিশেষ তহবিল গঠন করা উচিত, যা এই পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সহা​য়ক হবে, সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রেস কাউন্সিলের এই উদ্যোগটি সাংবাদিকতার মান উন্নয়নে একটি মাইলফলক হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং সাংবাদিকদের যথাযথ সহায়তা প্রদান করা হয়।​