ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাই স্কুল যার অন্যতম উদাহরণ। প্রায় ১৭ বছর ধরে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় স্কুলটিতে নিম্নবিত্ত সন্তানদের পড়াচ্ছিলেন তাকবীর আহমেদ। করোনাভাইরাসের কারণে স্কুলে শিক্ষার্থী নেই, কিন্তু খাড়া আছে ব্যয়ভার। কয়েক মাস পকেট থেকে খরচ চালানোর পর এবার স্কুল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
তাকবীর আহমেদ বলেন, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এখন কী করবো বলেন? মানুষ সন্তানের লাশ ফেলে দেয় না? এখন আমাকে সেটাই মনে করতে হচ্ছে। আমার সন্তান মারা গেছে!
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে বেতন পেতেন সেটা দিয়েই শিক্ষকদের সম্মানিসহ সব খরচ মিটিয়ে নিজের কাছে কিছু থাকতো বলে জানিয়েছেন তাকবীর। কিন্তু গত ৩-৪ মাস ধরে ভাড়াটাও দিতে হচ্ছে পকেট থেকে। করোনাকালে প্রায় চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে তার। সামনের দিনগুলোর অনিশ্চয়তায় স্কুল বিক্রি করে দিচ্ছেন তিনি।
স্কুল বন্ধের কারণ প্রসঙ্গে তাকবীর বলেন, আমাদের স্কুলের যারা পড়েন, তাদের অভিবাবকরা সাধারণত গার্মেন্টস, বাসা-বাড়িতে কাজ করেন বা কেউ ড্রাইভার। আমি জানি কার কী অবস্থা। তাদের গিয়ে যদি বলি বেতনটা দেন, এর জন্য আমিই তো আমার বিবেকের কাছে বন্দী। এদিকে স্কুলের ভাড়া তো দিতে হবে, কারণ বাড়িওয়ালা ঋণ করে আমাকে বাড়ি করে দিয়েছেন।
রিনা আকতার নামের এক অভিবাবক বলেন, আমার দুই মেয়েই স্কুলটিতে পড়ে। এখন কোথায় পাঠাবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এর চেয়ে বড় স্কুলে ভর্তি করানোর তো সামর্থ নেই আমাদের। এখন কিছু না কিছু তো কিছু করতেই হবে।
ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন বিক্রির বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে মোহাম্মদপুরের অলি-গলি। কিন্তু তদবির আহমেদ জানালেন, এত বিজ্ঞাপন দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। দুই-একজন ফোন দিলেও তারা স্রেফ দাম জেনেই ফোন কেটে দেন।
এমন বিপর্যয়ে রাজধানীর আরো অনেক কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুলই বিপদে পড়েছে। দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়িভাড়ার পাশাপশি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না প্রতিষ্ঠানগুলো।
স্কুলের আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সহকর্মীদের নিয়ে মৌসুমি ফল বিক্রি করছেন ঢাকার আদাবরের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ আমিনা বেগম তামান্না। তিনি বলেন, আমার প্রয়োজনে আমি রাস্তায় নেমেছি। আমি আমার প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে চাই। এমনকি আমাদেরও তো সন্তান আছে, তাদের মুখেও তো খাবার তুলে দিতে হবে।
বাড়ি ভাড়া দিতে না পারায় স্কুলের বিল্ডিংয়ে পরিবার নিয়ে উঠেছেন আমিনা বেগম তামান্না। তিনি বলেন, আমি স্কুল ভাড়াই জোগাড় করতে পারছি না, বাসা নিয়ে থাকবো কীভাবে। তাই একটা জায়গায় এসেছি, যাতে কিছুটা হলেও আমার সাশ্রয় হয়।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান জানান, তাদের কাছে আসা তথ্যমতে এখন পর্যন্ত ঢাকায় অন্তত ১৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আর বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেয়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিতে আরো প্রায় শতাধিক স্কুল রয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, রাজধানীর অধিকাংশ পরিবারের পক্ষেই তাদের সন্তানদেরকে নামিদামি স্কুলে পড়ানোর আর্থিক সঙ্গতি থাকে না। তাই তাদের একমাত্র আশ্রয় গলির ভেতরে থাকা সাধারণ মানের ছোট ছোট স্কুলগুলো। সবমিলিয়ে কয়েক লাখ শিশু এসব স্কুলে লেখাপড়া করে থাকে। করোনার কারণে স্কুলগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে হুমকির মুখে পড়বে এসব শিক্ষার্থীর লেখাপড়া।